আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ঃ গান ও গায়ক।
গান ও গায়ক
গান ও গায়ক
গানঃ ছন্দে ও সুরে গ্রথিত কাব্যকে গান বলে। ধ্রুপদ গানে সাধারণত ৪টি কলি থাকে। যথাঃ স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ। স্থায়ীর সুর নীচুর দিকে থাকে। অন্তরা ও আভোগ গাওয়ার পর এই কলিতেই স্থিতি হয়। অন্তরায় সুর স্থায়ী থেকে অন্তরা বা পৃথক হয়ে উঁচুর দিকে যায়।
সঞ্চারীর সুর পুনরায় নীচের দিকে সঞ্চরণ করে এবং আভোগে পুনরায় সুর উঁচুর দিকে যায়। সঞ্চারীর সুর পুনরায় নীচের দিকে সঞ্চারণ করে এবং আভোগে পুনরায় সুর উঁচুর দিকে উঠে গানের ভোগ বা বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। সঞ্চারীর পর স্থায়ীতে কখনই ফিরে যাওয়া হয় না, সঞ্চারী ও আভোগ একটানা গাওয়া হয় । কলি সংখ্যা ও কলির সুর বৈশিষ্ট্য এগুলো সাধারণ নিয়ম ধ্রুপদ ও অন্যান্য গানে তার নানা ব্যতিক্রম আছে।
গায়কঃ সঙ্গীত শাস্ত্রে গায়কের পাঁচ প্রকার শ্রেণীভেদ করা হয়েছে। যেমনঃ শিক্ষাকার, অনুকার, রসিক, রঞ্জক ও ভাবুক। শিক্ষাকার শিক্ষা কার্যে অধিকারী। অনুকার- অন্য গায়কের অনুকরণকারী। রসিক- রসাবষ্ট গায়ক। রঞ্জক- শ্রোতার মনোরঞ্জনকারী ।
ভাবুক-সঙ্গীতে নবসৃষ্টির অধিকারী। সঙ্গীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে গায়কের নানা প্রকার ত্রুটি বা মুদ্রাদোষ থাকতে দেখা যায়। আমাদের সঙ্গীত শাস্ত্রে গায়কের নানা দোষের কতকগুলো লক্ষণ নির্দিষ্ট হয়েছে এবং উত্তম গায়কের কতকগুলো সুলক্ষণ সম্বন্ধেও উল্লেখ করা হয়েছে।
গান পরিবেশন কালে যে রস উৎপন্ন হয় তার সঙ্গে গায়কের দোষ গুণ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। গায়কের পক্ষে দোষগুলোর হাত থেকে মুক্ত থাকার জন্য সর্বদা সচেষ্ট হওয়া আবশ্যক। কারণ, দোষগুলোর জন্য রসসৃষ্টি বিঘ্নিত হয় ।
গায়কের দোষ ২৫(পঁচিশ) প্রকার। যথাঃ
১ । সংদষ্ট – যিনি দাঁত চিবিয়ে গান করেন।
২ । উদ্স্ফুষ্ট – যিনি রসহীনভাবে চীৎকার করেন ।
৩ । সুকারী – গাওয়ার সময় যিনি অবাঞ্চিত আওয়াজ করেন ।
8 । ভীত – যিনি ভীতভাবে গান করেন ।
৫ । শঙ্কিত – যিনি গাওয়ার সময় অনাবশ্যক তাড়াহুড়া করেন ।
৬। কম্পিত – গাওয়ার সময় যার শরীর ও কন্ঠ কম্পিত হয়।
৭। করালী – যিনি অতিরিক্ত হাঁ করে ভয়ানকভাবে গান করেন ।
৮। বিকল – যাঁর কণ্ঠ ঠিক শ্রুতিস্থানে পৌঁছায় না ।
৯। কাকী – যাঁর কন্ঠ কাকের মতো কর্কশ।
১০। বিতাল – যাঁর তাল জ্ঞান নাই ।
১১। করভ – যিনি ঘাড় অতিরিক্ত উঁচু করে গান করেন ।
১২। উদ্ভট – যিনি মুখ বিকৃত করে গান করেন।
১৩। কোম্বক – যিনি গলা ফুলিয়ে গান করেন ।
১৪। তুম্বকী – যিনি গাল ফুলিয়ে গান করেন ।
১৫। বক্রী – যিনি ঘাড় হেলিয়ে গান করেন।
১৬। প্রসারী – যিনি হাত পা ছড়িয়ে গান করেন।
১৭। নির্মাণক – যিনি চোখ বুজে গান করেন।
১৮। বিরস – যার গায়ন নীরস।
১৯। অপস্বর – যিনি বর্জনীয় স্বর প্রয়োগ করেন।
20 । অব্যক্ত – যার বাণী অস্পষ্ট।
২১। স্থানভ্রষ্ট – যার কণ্ঠে তিন সপ্তকের ঠিক ঠিক স্বরস্থানে পৌঁছায় না।
২২। অব্যবস্থিত – যিনি সুশৃঙ্খলভাবে গাইতে পারেন না।
২৩। মিশ্রক – যাঁর গায়নে শুদ্ধ ছায়ালগ আদি রাগ মিশ্রিত হয়ে যায়।
২৪। অনবধানক – গাওয়ার সময় যথাক্রম বিকাশে যাঁর লক্ষ্য থাকে না।
২৫। সানুনাসিক – যিনি নাকি সুরে গান করেন।
উত্তম গায়কের নিম্মলিখিত গুণ ২৩ (তেইশ) প্রকার। যথাঃ
১। হৃদ্যশব্দ – মনোহর কণ্ঠের অধিকারী।
২। সুশারীর -যাঁর আওয়াজ অভ্যাস ছাড়াই রাগ বিশেষের স্বরুপ প্রকাশ করতে সমর্থ ।
৩। গ্রহমোক্ষবিচক্ষণ – গানের আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত ক্রিয়ায় কুশল ।
8 । অঙ্গকোবিদ্ – রাগ, রাগাস, ভাষাঙ্গ, ক্রিয়াস ও উপাঙ্গ সম্বন্ধে জ্ঞানবান ।
৫। প্রবন্ধগাননিষ্ণাত – প্রাচীনকালে প্রচলিত প্রবন্ধগান সম্বন্ধে যিনি অভিজ্ঞ ।
৬। বিবিধালণ্ডিতত্ত্ববিৎ – নানা প্রকার আলাপের তত্ত্বে কুশল ।
৭। সর্বস্থানোথগমকে – স্বনায়াসলসদ্ গতি অনায়াসে মন্ত্র, মধ্য ও তার সপ্তক গামী গমক প্রয়োগে সক্ষম।
৮। আয়ত্ত্বকণ্ঠ – স্বাধীনভাবে কন্ঠস্বর প্রয়োগে সক্ষম ।
৯। ভালজ্ঞ – তালে পারদর্শী
১০। সাবধান – যিনি একাগ্রচিত্তে গান করতে পারেন। –
১১। জিতশ্রম – গানে যার ক্লান্তি নাই ।
১২। শুদ্ধছায়ালগাভিজ্ঞ – যিনি শুদ্ধ, ছায়ালগ ইত্যাদি রাগভেদ জানেন ।
১৩। সর্ব – কাকুবিশেষবিৎ সর্বপ্রকার কাকু বিশেষজ্ঞ।
১৪। অপার – স্থায় সঞ্চার বহু রাগের প্রয়োগে সমর্থ ।
১৫। সর্বদোষ – বিবর্জিত সব দোষ থেকে মুক্ত।
১৬। ক্রিয়াপর – যিনি নিয়মিত অভ্যাস দ্বারা সঙ্গীত পারদর্শিতা লাভ করেছেন ।
১৭। অজস্রলয় – বিভিন্ন প্রকার লয় প্রয়োগে নিপুন ।
১৮। সুঘট – স্বর, বর্ণ ও তাল যথাযোগ্যভাবে সংযোজন করতে সক্ষম।
১৯। ধারণান্বিত – উত্তম স্মৃতিশক্তির অধিকারী।
২০। স্কুজনির্জবন -“নির্জবন” নামক বিশেষ রাগাবয়র প্রয়োগে সক্ষম। নির্জবন-যে রাগাবয়বের সরল, সুমধুর ও রাগবাচক স্বর ক্রমশঃ সূক্ষ্মতর হয়।
২১। হারিরহঃ – কৃচ্চজনোদবর- যার গানের প্রভাবে শ্রোতাগণ মুগ্ধ হন।
২২। ভজনোর – রাগের পূর্ণ অভিব্যক্তিতে অভিজ্ঞ ।
২৩। সুসম্প্রদায় – উত্তম গুরু পরম্পরাশীল।
আরও দেখুন: