গান শিখানোর জন্য যা জানা বিশেষ প্রয়োজন

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ঃ গান শিখানোর জন্য যা জানা বিশেষ প্রয়োজন।

গান শিখানোর জন্য যা জানা বিশেষ প্রয়োজন

 

গান শিখানোর জন্য যা জানা বিশেষ প্রয়োজন

 

গান শিখানোর জন্য যা জানা বিশেষ প্রয়োজন

যাদের ছেলেমেয়েরা গান শিখেন কিংবা শিখাবেন, তাঁদের এ সম্বন্ধে কিছু জানা কর্তব্য। অনেক অভিভাবক মনে করেন লেখা পড়ার সঙ্গে গান বাজনার শিক্ষা খুব ক্ষতিকর। তারা কি জানেন, দর্শন, বিজ্ঞান, কাব্য, সাহিত্যে সব কিছুই সমাবেশ ঘটেছে সঙ্গীতে। তাই শিশুকে একজন পূর্ণাঙ্গ সংস্কৃতিবান নাগরিক করে গড়ে তুলতে হলে তার জীবনে সঙ্গীতেরও প্রয়োজন অনেকখানি।

সঙ্গীত জীবনকে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ করে তোলে। তাই বিশ্বের যে কোন সভ্য দেশেই লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই নাচ-গান বাজনা শিক্ষা দেওয়ার প্রথা চালু হয়েছে। এর পরেও কি অভিভাবকরা বলবেন গান বাজনা শিখলে লেখাপড়ার ক্ষতি হয়?

ছোটদের গান ভালো বা মন্দ যেমনই হোক না কেন, সমঝদার শ্রোতার কখনোই তার বিরুদ্ধে সমালোচনা করেন না। বরং প্রশংসাই করেন, তাদের উৎসাহ দেবার জন্য । কিন্তু সঙ্গীতে অনভিজ্ঞ অভিভাবকেরা ঐ প্রশংসায় নিজেদের বিচার বুদ্ধির ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে মনে করেন, তাদের সন্তানেরা বুঝি শিল্পীস্তরে পৌঁছে গেছে।

বোঝেন না যে, শিল্পী হওয়াটাকে তারা যত সহজ সাধ্য মনে করেন, বিষয়টা ঠিক ততখানি সহজ হয় । ঈশ্বরদত্ত সুকন্ঠ বা অনুসরণ পটুত্ব থাকলেই শিল্পী হওয়া যায় না। তার জন্য যথেষ্ট ধৈর্য, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের দ্বারা শিক্ষার কয়েকটি স্তর অতিক্রম করতে হয় ।

তানসেন থেকে শুরু করে যদুভট্ট পর্যন্ত সকল প্রতিভাবানকেই গুরুমুখী বিদ্যা শিক্ষা করতে হয়েছে। অভিভাবক ও শিক্ষক/শিক্ষিকা- উভয়কেই মনে রাখতে হবে যে, ভালো গান গাইতে পারা এবং ভালো শিক্ষক হওয়া এক জিনিস নয়।

বড়দের গান শেখানো অপেক্ষা ছোটদের গান শেখানো অনেক বেশী কঠিন। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে কিন্তু সেটা ব্যতিক্রমই। সঙ্গীত যে একটি বিশিষ্ট কলা বিদ্যা। সে বিদ্যাও যে রীতিমত শিক্ষা সাপেক্ষ, এ কথা উভয়েরই মনে রাখতে হবে।

১। সঙ্গীত শিক্ষার কি কোন বয়স আছে?

সঙ্গীতের শিক্ষার কোন বয়স নেই। মনে সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ থাকলে, নিষ্ঠা ও সাধনা থাকলে যে কোন বয়স থেকে সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করা যায়।

২। সঙ্গীত শিক্ষার্থীর বয়স

শিশু অবস্থা ৫ বছর থেকে ১০ বছর এবং ১০ বছর থেকে ১৫ বছর। ১৫ বছর থেকে ছেলে ও মেয়েদের কন্ঠস্বর স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তন হয় সুতরাং সেই সময় স্কেল পরিবর্তন করা প্রয়োজন হতে পারে। স্বাস্থ্য ও কন্ঠস্বরের স্বাভাবিক অবস্থা অনুসারে আবার ১৮ বছর থেকে ৩৬ বা ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত কন্ঠস্বরের Growth বা বলিষ্ঠতা লক্ষ্য করা যায়।

৩। শিক্ষার্থী নির্বাচন

যখন একসঙ্গে অনেকগুলো ছেলে মেয়েকে গান শেখাতে হবে, তখন সর্বাগ্রে শিক্ষার্থী বাছাই করা দরকার। কারণ, দেখা গেছে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সব শিশুরাই গান গাইতে পারে না। কারো গলায় হয়তো সুর নেই, আবার কারো গলা হয়তো গানের উপযোগী নয়। তাই এদের বাছাই করে ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ করা দরকার। প্রথমে দলে থাকবে, যাদের গলা আদৌ গাইবার মত নয়।

দ্বিতীয় দলে থাকবে, যাদের গলা (কন্ঠপেশীগুলো) এখনো গাইবার উপযুক্ত হয়নি। তৃতীয় দলে থাকবে, যাদের সুর বোধ আছে এবং সুর শুনে ঠিক মত অনুসরণ করতে পারে। যাদের কথায় জড়তা কিংবা জিভের আড়ষ্টতা আছে, অথবা অন্য কোন রকমের অসুখ বিসুখ আছে, তাদের পক্ষে যথাযোগ্য চিকিৎসা না করে ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া জোর করে গাওয়ানোর চেষ্টা ক্ষতিকর হবে ।

৪। কণ্ঠ বৈশিষ্ট্য ও স্বর সাধনা

দল বাছাইয়ের পর নজর দিতে হবে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠ-বৈশিষ্ট্যের দিকে- শিশুদের কন্ঠস্বর স্বভাবতই খুব কোমল ও মৃদু এবং উঁচু ও সুরু হয়। অর্থাৎ নিচু ও গম্ভীর হয়না । এ অবস্থায় যাতে তাদের গলায় কোন রকম চাপ মানে জোর না পড়ে । খুব চিৎকার করে কিংবা চাপা গলায় গাইলে গলায়, জোর পড়ে।

উভয় ক্ষেত্রেই কন্ঠস্বরের ক্ষতি হয়। তাই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মোলায়েম গলায় তাদের গান গাওয়ানো উচিত। পরিণত বয়স্ক ছেলে ও মেয়েদের কন্ঠ পরিধি বা পরিসরে (কম্পাস) যেমন তারতম্য থাকে, শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত তেমন পার্থক্য দেখা যায় না। অনেক জায়গায় যে কোন একটি স্কেলেই সবাইকে সমস্বরে গাওয়ানো হয়। আমার মনে হয় সেটা ঠিক নয়। সেই জন্যই শিক্ষার্থী বাছাইয়ের কথা বলেছি।

 

গান শিখানোর জন্য যা জানা বিশেষ প্রয়োজন

 

গলা সাধানোর নানা পদ্ধতি আছে। সব শিক্ষার্থীর জন্য একই পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত নয়। কণ্ঠগুণের তারতম্য অনুসারে অভিজ্ঞ শিক্ষক/শিক্ষিকারা পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটান। সমবেত শিক্ষার সময় অবশ্য সেরূপ সম্ভব নয়। প্রাথমিক শিক্ষার প্রারম্ভে নির্দিষ্ট কয়েকটি পাঠ সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই বইয়ের গলা সাধার যে অলংকারগুলো দেওয়া হয়েছে। ঐভাবে স্বরাভ্যাস করালে, একই সঙ্গে গলায় ও কানে সুর বসবে এবং লয়েরও বোধ হবে ।

৫। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ

শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ শুধু ছোটদের নয়, সকল বয়সের গায়কদের পক্ষেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকে একদমে যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ পর্যন্ত একটানা গাইতে গাইতে যখন দম ফুরিয়ে যায় তখন এক বেয়াড়া জায়গায় এসে দম নেয়। এভাবে গাইলে,

প্রথমত, গানের কথা ও সুরের বিকৃতি ঘটে- যার জন্য ছন্দ-নির্ণয় (স্ক্যানশন) ঠিক হয় না, দ্বিতীয়ত রস-সৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটে, তৃতীয়ত তাড়াতাড়ি দম ফুরিয়ে যায় । এইভাবে শ্বাস- প্রশ্বাসের অনিয়ন্ত্রণ স্বাস্থ্যের পক্ষেও অত্যন্ত ক্ষতিকর।

অনেকে হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে গানের কথাকে কেটে কেটে গান গায়। এতেও গান শুনতে ভালো লাগে না। এই সব ত্রুটির দিকে শিক্ষক/শিক্ষিকারা প্রথম থেকেই লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে অন্যান্য মুদ্রাদোষের প্রতিও। অনেক মস্তবড় হাঁ মুখ করে স্বরোচ্চারণ করে। আর মুখের চেহারাও যেন বিকৃত না হয়। সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে ।

৬। গান নির্বাচন

এমন এক সময় ছিল যখন ছোটদের উপযোগী গান পাওয়া যেত না। কারণ ছোটদের গান শেখানো তখন নিষিদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও কোন সঙ্গীতানুরাগী অভিভাবক যদি তাঁর শিশু বা কিশোর সন্তানকে গান শেখানোর ব্যবস্থা করতেন, তখন বড়দের গানই তাদের শেখানো হতো। সুখের বিষয়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে আরম্ভ করে একালের অনেকেই শিশুদের সে অভাব দূর করেছেন। রকমারি গান তাঁরা লিখেছেন ছোটদের জন্য ।

যে গান শিশুদের পছন্দ নয়, সে গান তাদের জোর করে শেখানো উচিত নয় । তাদের পছন্দ মত গান নির্বাচনের সময়, রচনা যাতে শিশুদের উপযোগী এবং রুচিসম্মত হয়। সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। একই গান বেশীদিন শেখানো শিশুদের মনে বিরক্তি আসে। যে গান তারা খুশী মনে, অল্প সময়ের মধ্যে মোটামুটিভাবে গাইতে পারে, সেই রকম নতুন গানই তাদের জন্য বাছাই করে শেখাতে হবে।

৭। গান শোনানোর ব্যবস্থা

যারা গান শেখেন, তা যে বয়সেরই হোক না কেন, আরেকটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয় হলো গান শোনা। এটিও শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ। গান বাজনা হলো শোনার জিনিস। ভালো গান শুনলে যেমন কান তৈরী হয়, তেমনি তাদের মনেও তার প্রভাব পড়ে। তাতে ভালো গান গাইবার আগ্রহ ও চেষ্টা বৃদ্ধি পাবে। তাই অভিভাবকদের উচিত তাদের মাঝে মাঝে সঙ্গীতানুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া। তাছাড়া রেডিও আর টেলিভিশন তো আছেই ।

৮। কিভাবে গান শেখাতে হবে

যে গানটি শিখাতে হবে, সেটি শিক্ষক/শিক্ষিকাকে প্রথমে এমন চিত্তাকর্ষকভাবে গেয়ে শোনাতে হবে, যাতে সেটি শেখবার আগ্রহ তাদের হয়। গানের মাধ্যমে গানের বাণীগুলো বুঝতে অনেক সময় অসুবিধে হয়। সে জন্য গান শেখাবার আগে কথাগুলো যদি কবিতার মত আবৃত্তি করে শোনানো যায়, তাহলে তা বুঝতে শিক্ষার্থীদের সুবিধে হবে।

শিক্ষক/শিক্ষিকা যখন গেয়ে দেখাবেন, শিক্ষার্থীরা তখন শুনবে, গাইবে না। শিক্ষকের গান থামার পর সেই অংশটুকু শিক্ষার্থীরা গাইবে। এইভাবে কয়েকবার পুনরাবৃত্তির পর যখন মুখস্থ হয়ে যাবে, তখন তারা স্বচ্ছন্দে হারমোনিয়াম ও তবলার সঙ্গে গাইতে পারবে । সম্পূর্ণ আয়ত্তের পর, কোন যন্ত্রের অনুষঙ্গ ছাড়াও তারা গাইতে পারবে নির্ভুলভাবে।

 

গান শিখানোর জন্য যা জানা বিশেষ প্রয়োজন

 

শিক্ষক/শিক্ষিকা এবং অভিভাবক সকলেই স্বীকার করবেন যে, যিনি তাড়াতাড়ি সব জিনিস ব্যস্ততার সঙ্গে সেরে ফেলতে চান, সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁর ব্যর্থতা তত বেশী প্রকট হবে, ধৈর্য ও সাধনা একান্ত প্রয়োজন। “ফুলকে যেমন মানুষ জোর করে তাড়াতাড়ি ফোটাতে পারে না- পারে গাছের যত্ন করে গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে, ফুলের যখন ফোটার সময় হবে ফুল নিজের জন্যই ফুটবে- সেই রকম গান শেখার জন্য ধৈর্য ও সাধনা প্রয়োজন । অধৈর্য হলে সঙ্গীত জীবনে সফলতা আসে না। মনে রাখতে হবে, “গান শুধু কণ্ঠকে সুন্দর করে না মনকেও সুন্দর করে”।

আরও দেখুন:

Leave a Comment