সঙ্গীত মানুষের আবেগ, চিন্তা এবং সংস্কৃতির এক অম্লান ভাষা, যা যুগ যুগ ধরে মানবজীবনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নিজেদের প্রকাশের মাধ্যম হয়ে এসেছে। গীত, বাদ্য এবং নৃত্যের সমন্বয়ে গঠিত এই কলাটি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং মানুষের মনোজগৎ ও সংস্কৃতির গভীর প্রতিফলন। সঙ্গীতের বিভিন্ন উপাদান ও তত্ত্ব বোঝার মাধ্যমে আমরা এর প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য এবং মানব জীবনের সাথে এর অটুট সম্পর্ক সম্পর্কে গভীর ধারণা লাভ করতে পারি। এই প্রবন্ধে সঙ্গীতের সংজ্ঞা, স্বর ও সপ্তক সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হবে, যা আমাদের সঙ্গীত জগতের জ্ঞান সমৃদ্ধ করবে এবং ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে।
সঙ্গীতের বিষয়ক সংজ্ঞা
ক্র. | বিষয়/পরিভাষা | সংজ্ঞা ও বর্ণনা |
১। | পরিভাষা | যে ভাষা দিয়ে কোনো শব্দের বিশেষ অর্থ বুঝানো হয়, তাকে পরিভাষা বলা হয়। |
২। | সঙ্গীত | গীত, বাদ্য ও নৃত্য এই তিনটি কলার সম্মিলনে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তাকে সঙ্গীত বলা হয়। প্রত্যেকটির সংজ্ঞা ভিন্ন: – গীত: কথা, সুর ও তালের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ। – বাদ্য: সুর ও তালের মাধ্যমে যন্ত্রের সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ। – নৃত্য: ছন্দ ও মুদ্রার মাধ্যমে সুললিত অঙ্গভঙ্গিতে মনের ভাব প্রকাশ। তবে প্রতিটি আলাদা একটি স্বতন্ত্র কলাবিদ্যা। |
৩। | সপ্তক | “সা” হতে “নি” পর্যন্ত ৭টি শুদ্ধ স্বর ক্রমানুসারে লিখিত ও সঙ্গীতে ব্যবহৃত হলে তাকে সপ্তক বলা হয়। সপ্তক তিন প্রকার: উদারা বা যন্ত্র সপ্তক, মুদারা বা মধ্যসপ্তক, এবং তারা বা তার সপ্তক। ৭টি শুদ্ধ স্বর: ষড়জ (সা), রেখাব (রে), গান্ধার (গা), মধ্যম (মা), পঞ্চম (পা), ধৈবত (ধা), নিষাদ (নি)। |
৪। | সপ্তকের স্বরের তালিকা ও সংক্ষিপ্ত উচ্চারণ | |
পূর্ণাঙ্গ নাম | ষড়জ, রেখাব, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদ | |
সংক্ষিপ্ত উচ্চারণ | সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি | |
৫। | সপ্তকে মোট স্বর (শুদ্ধ ও বিকৃত) | ১। সা = ষড়জ্ ২। ঋা = কোমল রেখাব ৩। রে = শুদ্ধ রেখাব ৪। জ্ঞা = কোমল গান্ধার ৫। গা = শুদ্ধ গান্ধার ৬। মা = শুদ্ধ মধ্যম ৭। কড়ি মধ্যম ৮। পা = শুদ্ধ পঞ্চম ৯। দা = কোমল ধৈবত ১০। ধা = শুদ্ধ ধৈবত ১১। পা = কোমল নিষাদ ১২। না = শুদ্ধ নিষাদ |
৬। | সঙ্গীতের উৎপত্তি | মানবজাতির বিবর্তনবাদ মেনে নেওয়া হলে সঙ্গীত ও নৃত্যের অভিব্যক্তি মানব বিকাশের সাথে সম্পর্কিত। সঙ্গীতের জন্ম সম্পর্কে পৌরাণিক ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা থাকলেও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তত্ত্ব বিদ্যমান। আদিম জাতিরাও সঙ্গীতের উৎপত্তি নিয়ে নানা মত পোষণ করেছে। ভারতীয় শাস্ত্রে সঙ্গীতের সৃষ্টি, নাদের উৎপত্তি ও স্বরের বৈশিষ্ট্য নানাভাবে আলোচিত হলেও পাশ্চাত্য দেশে মানবজীবনের বিবর্তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তত্ত্বগুলো আরও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। |
🎶 সঙ্গীতের অন্যান্য বিষয় পরিচিতি:
ক্র. | বিষয় | ব্যাখ্যা |
১। | তুক | গানের পদ বা কলিকে “তুক্” বলা হয়। শাস্ত্রমতে তুক্ চার প্রকার— স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সাধারণত স্থায়ী ও অন্তরা তুক ব্যবহৃত হয়। তবে ধ্রুপদ গানে চারটি তুকই অপরিহার্য। |
২। | আশ | অবিচ্ছিন্নভাবে স্বরের উচ্চারণ পরপর হলে তাকে “আশ” বলা হয়। |
৩। | অম্লত্ব | রাগ পরিবেশনের সময় সব স্বরের সমান গুরুত্ব থাকে না। কোনো স্বরের স্বল্প প্রয়োগকে বলা হয় “অম্লত্ব”, যা দুই প্রকার— (ক) লঙ্ঘনমূলক অম্লত্ব: কোনো স্বর আরোহনে অতিক্রম করা হলেও বর্জন নয়; যেমন জৌনপুরী রাগে কোমল গা বা দেশ রাগে শুদ্ধ গা। (খ) অনভ্যাসমূলক অম্লত্ব: যেসব স্বরের প্রয়োগ খুব কম, ন্যাস করা যায় না; যেমন বিহাগ রাগে রে ও ধা। |
৪। | বহুত্ব | কোনো রাগে স্বরের অধিক প্রয়োগকে “বহুত্ব” বলে, যা দুই প্রকার— (ক) অলঙ্ঘনমূলক বহুত্ব: যে স্বর লঙ্ঘনযোগ্য নয়, কিন্তু ন্যাসযোগ্যও নয়; যেমন ইমন রাগের তীব্র মা। (খ) অভ্যাসমূলক বহুত্ব: যে স্বর বারবার ব্যবহৃত হয় বা যার উপর ন্যাস করা হয়; যেমন হিন্দোলে ধা, বাগেশ্রীতে ধা, পরজে নি। |
৫। | রাগমালা | এমন গান যার বিভিন্ন তুক বা কলিতে বিভিন্ন রাগের পরিচয় থাকে, তবে তাল একই থাকে, তাকে “রাগমালা” বলে। |
৬। | প্রবন্ধ | একই রাগে রচিত গান যার বিভিন্ন তুকে বিভিন্ন তাল ব্যবহৃত হয় তাকে “প্রবন্ধ” বলা হয়। |
৭। | বাগ্যেয়কার | যিনি একাধারে বাণী ও গীত সম্পর্কে দক্ষ, তাকে বলা হয় “বাগ্যেয়কার”। |
৮। | প্রকীর্ণ | গানের বিধি-প্রণালী, লক্ষণ, ব্যবহারিক শব্দ ইত্যাদিকে “প্রকীর্ণ” বলে। |
৯। | আলাপ | রাগ পরিবেশনের শুরুতে তাল ছাড়াই রাগের রূপ গেয়ে দেখানো হয়, একে “আলাপ” বলা হয়। অর্থহীন শব্দ যেমন: তান, নে, রে, তোম, নোম ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। |
১০। | বোল আলাপ | গান শুরু হওয়ার পর তালের সাথে পদের সাহায্যে করা আলাপকে “বোল আলাপ” বলা হয়। |
১১। | বিস্তার | রাগের স্থায়ী ও অন্তরা গাওয়ার পর স্বরের সাহায্যে গান ও রাগের রূপ বজায় রেখে, লয়ের সঙ্গে রাগ পরিবেশন করাকে “বিস্তার” বলা হয়। |
১২। | বহলাবা | আলাপের ঢঙে পরিবেশিত তান বা বোলতানকে “বহলাবা” বলা হয়। |
১৩। | বোল বিস্তার | গানের বাণীর সাহায্যে বিস্তারের রূপকে “বোল বিস্তার” বলা হয়। |
১৪। | বাঁট (বাট) | গানের কথার সাহায্যে দ্বিগুণ, তিনগুণ, চৌগুণ ছন্দে গাওয়াকে “বাঁট” বলা হয়। ধ্রুপদে বাঁটি আবশ্যিক, খেয়ালে বাঁট ও তান উভয়ই ব্যবহৃত হয়। |
১৫। | কম্পন | একটি স্বর দুলিয়ে দুলিয়ে উচ্চারণ করলে যে ধ্বনি তৈরি হয়, তাকে “কম্পন” বলে। যেমন: সাসাসা, রারারা ইত্যাদি। |
১৬ | বঢ়ত | গান বা বাজানোর সময় ধীরে ধীরে লয় বাড়িয়ে নিয়ে সরগম, বোলতান, গমক ইত্যাদির প্রয়োগকে সামগ্রিকভাবে বঢ়ত বলা হয়। |
১৭ | মুখ চালন | রাগ পরিবেশনের সময় গমক ও মীড় যুক্ত অলঙ্কারের সাহায্যে স্বর বিস্তারের ক্রিয়াকে মুখ চালন বলা হয়। |
১৮ | মূর্কী | মূর্কী এক প্রকার গমকের নাম। মতান্তরে তিন স্বরের এক অর্ধবৃত্তি দ্রুত উচ্চারিত হলে মূর্কী হয়। তবে এই তিন স্বরের মধ্যে একটি থাকে প্রধান স্বর, দুটি থাকে স্পর্শ স্বর। স্পর্শ স্বরের ব্যবহারই মূর্কী নামে খ্যাত। |
১৯ | রাগ সঙ্গীত | যে সঙ্গীত ধারার কেন্দ্রে রয়েছে রাগ রূপায়ণ তাকে রাগ সঙ্গীত বলা হয়ে থাকে। ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুংরী প্রভৃতি রাগ সঙ্গীত। |
২০ | বক্ররাগ | যে রাগে আরোহী বা অবরোহী বা উভয় ক্রমেই বক্র স্বরের প্রয়োগ বেশি থাকে তাকে বক্ররাগ বলে। বক্ররাগে ব্যবহৃত স্বরসমূহ স্বাভাবিকক্রম অনুযায়ী সরল গতিতে আরোহী বা অবরোহীতে প্রযুক্ত হয় না। |
২১ | অধম রাগ | অধম রাগ মানে অতি সঙ্কীর্ণ রাগ। যে রাগ বিস্তৃত আলাপের অযোগ্য এবং যা দ্বারা সবিস্তার ভাব প্রকাশ করা যায় না তাকে অধম রাগ বলে। |
২২ | স্বরবিস্তার | রাগের রূপ প্রকাশক ধীর গতি সম্পন্ন স্বর উচ্চারণকে স্বরবিস্তার বলে। স্বরবিস্তার সর্বদাই ধীর লয়ে সম্পন্ন হয়। |
২৩ | ছুট্ | কোন একটি স্বর হতে দূরবর্তী অন্য আর একটি স্বরে হঠাৎ যাওয়াকেই বলে। যেমনঃ সগা, সমা, সপা ইত্যাদি। |
২৪ | থম | লয়ের সাথে সুরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিশ্রাম স্থায়িত্বের নামকে “থম” বলে। |
২৫ | দম | গাইবার সময় লয়সহ কোন স্বরে অধিকক্ষণ (স্থায়িত্ব) দাঁড়ানোকে “দম” বলে। |
২৬ | অনিবদ্ধ গান | প্রাচীনকালে গানের রচনা বা বন্দিশের আলাপকে “অনিবদ্ধ গান” বলা হতো। এই গান তালযন্ত্র ছাড়া বিলম্বিত, মধ্য ও দ্রুত লয়ে গাওয়া হতো। |
২৭ | নিবন্ধ গান | প্রাচীনকালে সুর, তাল ও লয়যুক্ত গানের রচনা বা বন্দিশকে “নিবদ্ধ গান” বলা হতো। |
২৮ | মার্গ সঙ্গীত | মার্গ সঙ্গীত অত্যন্ত প্রাচীন। বিশেষ বিশেষ নিয়ম অনুসারে যে সকল রাগ পরিবেশন করা হয় তাকে মার্গ সঙ্গীত বলে। খ্রীস্টপূর্ব যুগে বৈদিকগান, সামগান থেকে বিষয়বস্তু নিয়ে যে অভিজাত গানের সৃষ্টি হয়ে তাকে মার্গ গান বা মার্গ সঙ্গীত বলে। মার্গ শব্দের অর্থ অনুসরণ করা, অন্বেষণ করা। বর্তমান ক্ল্যাসিকাল সঙ্গীতকে মার্গ প্রকৃতি সম্পন্ন সঙ্গীত বলা যেতে পারে। |
২৯ | দেশী সঙ্গীত | যে সকল রাগ পরিবেশনে কোন ধরা বাঁধা নিয়ম নেই এবং বিভিন্ন টং এ বাজানো বা গীত হয়, তাকে দেশী সঙ্গীত বলে। |
৩০ | গায়কী | সঙ্গীতের প্রয়োগ কলায় নিজ মৌলিকত্ব তথা ব্যক্তিত্বের প্রকাশকেই বলা হয় গায়কী। |
৩১ | নায়কী | সঙ্গীতের বিশুদ্ধ অবিকৃতরূপে প্রকাশ করাকেই নায়কী আখ্যা দেওয়া হয়। ‘নায়কী’ গান অর্থে বোঝায় যে গুরু পুরস্পরায় প্রাপ্ত সঙ্গীতের বন্দিশ যথাযথভাবে বাণী, স্বর এবং তাল সহযোগে প্রকাশ করা। |
৩২ | পন্ডিত | সঙ্গীত শাস্ত্রে পারদর্শী তথা জ্ঞানী এবং ক্রিয়াত্মক অংশে মোটামুটি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিকেই সঙ্গীতের ভাষায় ‘পন্ডিত’ বলা হয়। |
৩৩ | গায়ক | গুরুর কাছে যথারীতি শিক্ষার পর সেই গুরুমুখী বিদ্যার উপর নিজস্ব প্রতিজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব, পান্ডিত্য, রসবোধ ইত্যাদির দ্বারা যিনি নতুন বৈশিষ্ট্য আরোপ করতে পারেন, তাঁকেই বলা হয় গায়ক। |
৩৪ | নায়ক | শাস্ত্রীয় ও ব্যবহারিক উভয় সঙ্গীতে যিনি সমান দক্ষ, নতুন নতুন রচনায় যিনি পারদর্শী, তাঁকে নায়ক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। |
৩৫ | বিদারী | গান কিংবা আলাপের ছোট বড় বিভাগগুলোকে প্রাচীনকালে বলা হতো বিদারী। গীতের অবয়বগুলোর উপ-বিভাগকেও বিদারী বলা হতো। |
৩৬ | ধাতু | আজকাল যেমন কোন একটি গানের কবিতাকে স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও অভিভাগ এই চারটি স্তবকে ভাগ করা হয়, কিন্তু প্রাচীনকালে সেই স্তবকগুলোকে বলা হয় ধাতু। সেই পাঁচ রকম ধাতুর নাম- উর্দূগ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব, অন্তরা ও আভোগ। |
৩৭ | আক্ষিপ্তিকা | সঙ্গীতের মধ্যে যা স্বর, তাল ও শব্দ দ্বারা রচিত, তাকে বলা হয় আক্ষিপ্তিকা। ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল প্রভৃতি সবই আক্ষিপ্তিকা। |
৩৮ | ধ্বনি | সঙ্গীতের উৎপত্তি শব্দ বা ধ্বনি থেকে। আর ধ্বনির উৎপত্তি দুইটি জিনিসের সংঘর্ষ বা সংঘাত থেকে। অর্থাৎ কোন জিনিসের সংঘর্ষ বা সংঘাত থেকে যে আন্দোলন বা কম্পন হয়, তা থেকে ধ্বনির উৎপত্তি। ধ্বনি দুই প্রকার: মধুর ধ্বনি ও কর্কশ ধ্বনি। মধুর ধ্বনি হলো নাদ এবং কর্কশ ধ্বনি হলো কোলাহল। |
৩৯ | স্থান | স্থান অর্থ জায়গা। সঙ্গীতে দেখা যায় যে, কখনও উচ্চগ্রামে আবার কখনও নিম্নগ্রামে স্বর প্রয়োগ হচ্ছে। স্বরের এই উঠা-নামা তিনটি স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। স্বরের উঠা-নামার এই ক্ষেত্রে বা জায়গাকে স্থান বলে। এই তিনটি স্থান ‘নাদ স্থান’ নামে পরিচিত। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানের নাম যথাক্রমে উদারা, মুদারা ও তারা। |
৪০ | স্বরাবর্ত | সাগাম বা স্বরমালিকার আরেক নাম সুরাবর্ত। স্বরের প্রয়োগ স্বরের একটা আবর্ত আছে বলেই তাকে সুরাবর্ত বলা হয়। |
৪১ | রাগালাপ | আলাপে রাগের গ্রহ, অংশ, ন্যাস, অপন্যাস; সন্ন্যাস, বিন্যাস, অপত্ব, বহুত্ব, মন্ত্র ও তার এই দশটি নিয়ম পালিত হলে তাকে রাগালাপ বলে। |
৪২ | রুপকালাপ | প্রাচীনকালের প্রবন্ধ গানের বৈশিষ্ট্যগুলো যে আলাপে ফুটিয়ে তোলা হতো আভাসে ইঙ্গিতে, তাকে বলা হতো রুপকালাপ। এটি রাগালাপের পরবর্তী পর্যায়। |
৪৩ | আলপ্তি গান | অনিবদ্ধ গানেরই একটি প্রকার আলপ্তি গান। এই আলাপে রাগের পূর্ণ অংশ প্রকাশিত হতো। তাছাড়া রাগের অবির্ভাব-তিরোভাব ঘটিয়ে এই আলাপের মধ্যে বৈচিত্র্য দেখান হতো। রাগালাপ ও রুপকালাপের পর গাওয়া হতো আলপ্তি। |
৪৪ | উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত | ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুংরী প্রভৃতি বোঝাতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত কথাটির ব্যবহার দেখা যায়। উচ্চ অঙ্গের সঙ্গীত, এই অর্থে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। যে সঙ্গীত গঠনে, রূপায়ণে ও রস সম্পাদনে প্রচলিত অন্যান্য সঙ্গীত ধারা থেকে উচ্চ তারই নাম উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। |
৪৫ | কলাবন্ত | যে সঙ্গীতকার ঘনিষ্ঠ অনুশীলনের মাধ্যমে ক্রিয়াত্মক সঙ্গীতে সিদ্ধি লাভ করেন তাঁকে কলাবন্ত বা কলাকার বলা হয়। মধ্যযুগে যাঁরা ধ্রুপদ গাইতেন ও বীণা বাজাতেন তাঁদের কলাবস্তু বলা হতো। সম্রাট আকবরের সময় থেকে কলাবন্ত কথাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে বলে জানা যায়। |
৪৬ | কোরাস | কয়েকজন মিলে গান গাইলে কোরাস হয়। কথাটি পাশ্চাত্য সঙ্গীত থেকে আমাদের সঙ্গীত ধারায় জনপ্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সম্মেলক গান বা বৃন্দ গানের পাশ্চাত্য পরিভাষা। কোরাস দল শুধু পুরুষ বা শুধু নারী দ্বারা গঠিত হতে পারে। আবার নারী পুরুষ উভয় মিলেও হতে পারে। |
৪৭ | চলন | রাগ পরিবেশনের সময় রাগের রূপ প্রকাশের ধারাকে বলা হয় চলন। যন্ত্র বাদনেও চলন বা চাল কথাটি ব্যবহৃত হয়। |
৪৮ | বৃন্দ | বৃন্দ হলো সম্মিলিত সঙ্গীত। সম্মিলিত কন্ঠ সঙ্গীতকে বলা হয় বৃন্দগান বা বৃন্দগীতি। সম্মিলিত যন্ত্রবাদনকে বলা হয় বৃন্দ বাদন বা বাদ্যবৃন্দ। শাঙ্গদের “সঙ্গীত রত্মাকর” গ্রন্থে তৎকালীন বৃন্দ গঠন সম্পর্কে তিন প্রকার বৃন্দের কথা বলা হয়েছে: ১) উত্তম বৃন্দ: ৪ জন মুখ্য গায়ক, ৮ জন সহকারী গায়ক, ১২ জন গায়িকা, ৪ জন বংশী বাদক ও ৪ জন মৃদঙ্গ বাদক। ২) মধ্যম বৃন্দ: ২ জন মুখ্য গায়ক, ৪ জন সহকারী গায়ক, ৬ জন গায়িকা, ২ জন বংশী বাদক ও ২ জন মৃদঙ্গ বাদক। ৩) কনিষ্ঠ বৃন্দ: ১ জন মুখ্য গায়ক, ৩ জন সহকারী গায়ক, ৪ জন গায়িকা, ২ জন বংশী বাদক ও ২ জন মৃদঙ্গ বাদক। কোন বৃন্দে উত্তম বৃন্দ অপেক্ষা অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেশী হলে তাকে কোলাহল বৃন্দ বা গায়ক বৃন্দ বলা হয়। |
৪৯ | বৈতালিক | বৌদ্ধ যুগে জাতক বা প্রচলিত গাঁথাকে গানের মাধ্যমে যাঁরা পরিবেশন করতেন তাদেরকে বৈতালিক বলা হতো। |
৫০ | মাতৃ | গানের ভাষাকে প্রাচীন শাস্ত্রে মাতৃ বলা হতো। |
৫১ | বাজ | বাজাবার বিশেষ রীতিকে বাজ বলা হয়। যেমন, মজিদখান বাজ, রেজাখানি বাজ ইত্যাদি। |
৫২ | যুগলবন্দ | একজন যদি গান করেন আর সেই সঙ্গে আর একজন যদি সেই গানের সরগম প্রথম জনের সমান লয়ে গেয়ে যান তাহলে এই দ্বৈতগীতিকে যুগলবন্দ বলা হয়। |
৫৩ | রস | যে বাহ্যবস্তু বা গুণের আস্বাদনে দেহ বা চিত্তের স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে বা বিকৃতি ঘটে বা ভাবান্তর উপস্থিত হয় তাকে বলা হয় রস। |
৫৪ | স্বরসম্বাদ | দুই বা তার বেশী সংখ্যক স্বরকে এক আঘাতে বাজালে বা একই সঙ্গে গাওয়ার প্রক্রিয়াকে স্বরসম্বাদ বলা হয়। স্বরসম্বাদ কর্ডকেও বুঝিয়ে থাকে। |
৫৫ | স্বরাস্তর | দুই স্বরের মধ্যবর্তী ব্যবধানকে বা অন্তরকে স্বরান্তর বলা হয়। ইন্টারভ্যাল বলতেও স্বরান্তর বোঝায়। |
৫৬ | আখর | আখর হচ্ছে কীর্তন পরিবেশনের অঙ্গ অর্থাৎ কথার তান। কীর্তনের পদবাহিত ভাবকে কীর্তনীয় তাঁর রচিত কথার সাহায্যে মূর্ত করে তুললে আখর হয়। আখর রচনাকে পদের ব্যঞ্জনা প্রকাশক পদ্ধতি বলা হয়ে থাকে। পদ গাইবার সময় কীর্তনীয়া স্থানে স্থানে পদবাহিত ভাবকে অবলম্বন করে স্বয়ং কাব্য ও গদ্য ছন্দে কিছু রচনা করে গেয়ে শোনান তারই নাম আখর। |
৫৭ | কর্ত্তব | গীতে স্বর কৌশল প্রদর্শন করাকে কর্ত্তব বলা হয়। |
৫৮ | উপজ | গীতে ছোট ছোট তান নেয়ার নাম উপজ। |
৫৯ | জমজমা | জমজমা অর্থ কোন স্বরকে আন্দোলিত করা। সেতার বাদনে দু’টি স্বরকে দ্রুত একের পর এক করে বাজানোকে ‘জমজমা’ বলা হয়। |
৬০ | জোড় | আলাপের শেষাংশে বা আভোগকে ‘জোড়’ বলা হয়। এই অংশে আলাপের গতি দ্রুত ও ছন্দোবদ্ধ হয়। জোড়ের পর দ্রুতলয়ে ঝালার কাজ করে আলাপ শেষ করতে হয়। |
৬১ | অপেরা | এটা গীতি নাট্য। সঙ্গীত ও নাট্যকলার অপূর্ব সমন্বয়ে অপেরা রচিত হয়। অপেরায় থাকে একক, দ্বৈত ও সম্মেলক গান সহ নানা শ্রেণীর গান, কবিতা আবৃত্তি ও সংলাপ, অর্কেস্ট্রাসহ নানা ধরণের যন্ত্রবাদন, অভিনয় ও মুকাভিনয়, নৃত্য, দৃশ্য সজ্জা, অঙ্গসজ্জা প্রভৃতি বহুবিধ বিষয়ের বিপুল আয়োজন। এই বহুবিধ বিষয়ের মধ্যে ঐক্য স্থাপনেই অপেরার শক্তি নিহিত থাকে। |
৬২ | কবিয়াল | কবির দলের মুখ্য গায়ককে কবিয়াল বলা হয়। তিনি আসরে দাঁড়িয়ে তাঁর দল পরিচালনা করেন ও প্রতিপক্ষ দলের কবিয়ালের প্রশ্নের উত্তর দেন। গোজলা গুই আদি কবিয়াল রূপে অভিহিত হয়। |
৬৩ | বন্দিশ | বন্দিশ অর্থ বাঁধুনি বা বন্ধন। রাগের রুপরেখা প্রকাশের জন্য যে সকল স্বরসমষ্টি (নির্দিষ্ট আরোহন ও অবরোহন সম্বলিত) প্রবন্ধ গানে আস্থায়িত থাকে তাকে বন্দিশ বলা হয়। বন্দিশ বলতে সাধারণতঃ খেয়ালে ব্যবহৃত সেই নির্দিষ্ট গীতাংশকেই বোঝায়। যেখানে সুর ও লয়ের চমৎকার সমন্বয় থাকে, সেটিকে বন্দিশ বলা হয়। |
৬৪ | মেধা | মেধা হলো গানের নৈপুণ্য বা শিল্পী ও গায়কের প্রতিভা বা বুদ্ধিমত্তা। |
৬৫ | শ্রুতিবোধ | শ্রুতিবোধ শব্দটি আমাদের সংস্কৃত ভাষার। শ্রুতি শব্দের অর্থ ‘শোনা’ আর বোধ শব্দের অর্থ ‘বুঝা’। মানে শ্রুতিবোধ হচ্ছে সুর ও সঙ্গীত বোধ বা অনুভব। |
৬৬ | স্বরপট | স্বরপট হল স্বরের ছন্দ বা তাল বা যে ছন্দে স্বর প্রকাশ করা হয় তাকে স্বরপট বলে। |
৬৭ | রাগাঙ্গ | রাগের গঠন মূলক একটি প্রধান উপাদান রাগাঙ্গ। রাগাঙ্গ বলতে রাগে ব্যবহৃত স্বরের সংগঠন বুঝায়। |
৬৮ | তাল | তাল শব্দের অর্থ সময়, গতি বা ছন্দ। সঙ্গীতের তাল শব্দের অর্থ হচ্ছে স্বর বা শব্দের ছন্দ, যা ধ্রুবক বা নিয়মিত পরিমাণে পর্যায়ক্রমে পুনরাবৃত্ত হয়। |
৬৯ | সংগীত | সংগীত শব্দের অর্থ হচ্ছে সুর, ছন্দ, তাল ও লয়ের সমন্বয়ে গঠিত সুরেলা শব্দসমষ্টি। এটি মানুষের আবেগ ও অনুভূতিকে প্রকাশের মাধ্যম। |
৭০ | উঠাও | যে স্বরসমষ্টি দ্বারা গান-বাজনা শুরু বলা হয় সেই স্বরসমষ্টিকে উঠাও বলা হয়। পকড় আর উঠাও কিন্তু এক নয়। পকড় হলো, রাগবাচক মুখ্য কয়েকটি স্বর মাত্র। আর উঠাও হলো, যে স্বরসমষ্টি দ্বারা আরেকটা আলাপের মতো করে রাগ ধরা হয়। |
৭১ | তারপরণ | পাখোয়াজের পরণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাগবাচক স্বরসমূহ ব্যবহারকে তারপরণ বলা হয়। আলাপের শেষভাগে তারপরণ বাজানো হয়। |
৭২ | কসবী | উপযুক্ত গুরুর কাছ হতে শিক্ষাপ্রাপ্ত উপযুক্ত শিষ্যকে কসবী বলা হয়। |
৭৩ | অতাঈ | যে শ্রুতিধর শিল্পী গুরুর কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত না হয়ে নানাভাবে গান ইত্যাদি শুনে নিজে গাইতে সমর্থ হন তাকে অতাঈ বলে। |
৭৪ | স্থায় | রাগ পরিবেশনকালে যে ছোট ছোট স্বরসমষ্টি দ্বারা স্বরবিস্তার করা হয়, তাকে স্থায় বলা হয়। |
৭৫ | সঙ্গীত পদ্ধতি | সমগ্র উপমহাদেশীয় সঙ্গীতে দুই প্রকার পদ্ধতি প্রচলিত আছে — উত্তর ভারতীয় বা হিন্দুস্থানী সঙ্গীত পদ্ধতি ও দক্ষিণ ভারতীয় বা কর্ণাটকী সঙ্গীত পদ্ধতি। অর্থাৎ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, যে সঙ্গীত পদ্ধতি প্রচলিত আছে তাকে উত্তর ভারতীয় বা হিন্দুস্থানী সঙ্গীত পদ্ধতি বলে। কেবলমাত্র মাদ্রাজ, মহীসূর, অন্ধ্র ও কর্ণাটকে যে সঙ্গীত পদ্ধতি প্রচলিত আছে তাকে দক্ষিণ ভারতীয় বা কর্ণাটকী সঙ্গীত পদ্ধতি বলা হয়। |