উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং (১৯২৪ – ১৯৮৩)

আফগানিস্তানের কাবুলের খ্যাতনামা গজলশিল্পী ও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যতম বিশিষ্ট সাধক ছিলেন উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরা’হং। তিনি সাধারণভাবে “উস্তাদ সরা’হং” নামে পরিচিত এবং আফগানিস্তানের সংগীতের “মুকুটমণি” বা “Crown of Afghanistan’s Music” হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং
উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং

জন্ম ও শৈশব

তিনি ১৯২৪ সালে কাবুলের খারাবাত এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। এই এলাকা বহু বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী উৎপাদনের জন্য সুপরিচিত। তাঁর পিতা গুলাম হুসেন একজন সংগীতজ্ঞ ছিলেন, যিনি ছোটবেলা থেকেই পুত্রকে সংগীতের প্রাথমিক পাঠ দেন।

পরে উস্তাদ সরা’হং ভারতের পাটিয়ালা ঘরানার অধীনে বিখ্যাত গায়ক আশিক আলি খানের কাছে ১৬ বছর ধরে শাস্ত্রীয় সংগীতের গভীর শিক্ষা নেন।

উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং
উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং

কর্মজীবন ও শিল্পচর্চা

১৯৪৯ সালের দিকে, প্রায় ২৫ বছর বয়সে, তিনি আফগানিস্তানে ফিরে আসেন। তখন থেকে তিনি খেয়াল, ঠুমরি, তরানা ও গজলসহ শাস্ত্রীয় ও অর্ধশাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন করতে থাকেন।
তিনি বিশেষভাবে ফারসি কবি আমির খসরু ও আব্দুল কাদির বেদিলের গজল গাইতেন। বেদিলের সাহিত্য বিষয়ে গভীর জ্ঞানের কারণে তাঁকে বেদিল শেনাস (Bedil-expert) বলা হতো।

১৯৪৯ সালে কাবুলের পামির সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত এক সংগীত উৎসবে তিনি কাসিম ও বাদে গুলাম আলি খানের সঙ্গে অংশ নেন। সেখানে তাঁর অসাধারণ পরিবেশনের জন্য তাঁকে স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে আফগান সরকার তাঁকে “সরা’হং” উপাধিতে ভূষিত করে।

উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং
উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং

গ্রন্থ ও রাগসৃষ্টি

তিনি শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে দুটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন—

  1. কানুন-এ-তারব (Qānūn-e Tarab) – সংগীতের নীতি ও আইন বিষয়ে।

  2. মুসিকী-এ-রাগ-হা (Mūssīqī-e Rāg-hā) – রাগসঙ্গীতের ব্যাখ্যা।

এছাড়াও তিনি নতুন কিছু রাগও সৃষ্টি করেন, যার মধ্যে হাজরামিনামালি উল্লেখযোগ্য। তিনি কাবুলের পুশতুন ঘাগ পত্রিকায় সংগীত বিষয়ক প্রবন্ধও লিখতেন।

উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং
উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং

উপাধি ও সম্মাননা

ভারতের বিভিন্ন সংগীত বিদ্যালয় থেকে তিনি বহু ডিগ্রি ও সম্মাননা লাভ করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  • কলকাতার কলাকেন্দ্র স্কুল অফ মিউজিক থেকে সংগীতে মাস্টার, ডক্টর ও প্রফেসরের ডিগ্রি।
  • চণ্ডীগড় স্কুল অফ মিউজিক থেকে “কোহে-বেলান্দ” (সংগীতের উচ্চতম পর্বত)।
  • এলাহাবাদের সেন্ট্রাল স্কুল অফ মিউজিক থেকে “সর-তাজে-মুসিকী” (সংগীতের মুকুটমণি)।
  • ১৯৭৯ সালে নয়াদিল্লিতে শেষ কনসার্টে তাঁকে “বাবা-এ-মুসিকী” (সংগীতের পিতা) উপাধি দেওয়া হয়।
  • ১৯৮২ সালে এলাহাবাদে শেষ পরিবেশনে তাঁকে “শের-এ-মুসিকী” (সংগীতের সিংহ) উপাধি দেওয়া হয়।

 

উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং
উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং

 

মৃত্যু

১৯৮২ সালে ভারতে সফরের সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকের নির্দেশে তাঁকে গান ও কথাবার্তা বন্ধ রাখতে বলা হলেও, স্বদেশে ফিরে তিনি আবার সংগীত পরিবেশন শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি কাবুলে পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। আফগান তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রতিবছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানায়। ২০২১ সালে তাঁর ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়।

উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং
উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং

উত্তরসূরি

তাঁর পুত্র এলতাফ হুসেন সরাহং-ও একজন গজলশিল্পী।

উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং
উস্তাদ মোহাম্মদ হুসেন সরাহং

আফগান সংগীতাঙ্গনে উস্তাদ সরাহং-এর অবদান ছিল ঐতিহাসিক। তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে আফগান সংস্কৃতির সঙ্গে একীভূত করেছিলেন। তাঁর গজল ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবেশনা আজও আফগানিস্তান, ভারত ও পাকিস্তানে সংগীতপ্রেমীদের কাছে অমলিন। খারাবাত এলাকা যেখানে তিনি জন্মেছিলেন, সেটি কাবুলের সংগীত ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে আজও পরিচিত, অনেকটা ভারতের লখনৌ বা কলকাতার পুরোনো সংগীত মহল্লার মতো।

ফটো গ্যালারী:

Leave a Comment