কণ্ঠ সঙ্গীত শিল্পীদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য

কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পীদের প্রধান সম্পদ তাঁদের কন্ঠস্বর। তাই তাঁদের গলার যত্ন ও সাধারণ নিয়মগুলো পালন করা প্রয়োজন। শিল্পী জীবনে সফলতা আসে অনেক ব্যর্থতার পরে, সেই জন্য অনেক কবি, সাহিত্যক শিল্পী জীবনকে অভিশপ্ত জীবন বলে আখ্যা দিয়েছেন।

 

কণ্ঠ সঙ্গীত শিল্পীদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য

 

কণ্ঠ সঙ্গীত শিল্পীদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য

 

প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত কোন শিল্পী জীবনে সঙ্গীতের সফলতা সহজে আসেনি, অনেক ব্যর্থতা অনেক কষ্ট, অনেক অপমান অনেক অবহেলার পর হয়তো জনগন দেশবাসী শিল্পীর সৃষ্টিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

শিক্ষাকালে যদি কোন শিক্ষার্থী নিরাশ হয়ে পড়েন তবে তাঁর পক্ষে গানে অগ্রসর হওয়া কঠিন। সহজে যে জিনিষ পাওয়া যায় তাহা সহজে হারিয়ে যায়। সঙ্গীতের গভীরতা এবং বিষয়বস্তু এত বিশাল যে অল্প কথায় তা ব্যাখ্যা করা খুবই মুস্কিল।

মানুষের মনে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, মিলন, বিরহ, করুণ ইত্যাদি যে সব অনুভূতি আছে, যাহা সব সময় ভাষার দ্বারা প্রকাশ করা যায় না, সঙ্গীতের সুর ঐ সব অনুভূতি গানের বাণীর সঙ্গে মিশে গানকে সুন্দর সুষ্ঠভাবে প্রকাশ করতে সাহায্য করে।

কথার যেখানে শেষ, গানের সেখানে শুরু- কথা ও বাণীর নিজস্ব একটা প্রকাশ শক্তি থাকে এবং গানের সুর মানুষের অব্যক্ত ভাষাকে অনুভূতিশীল করে তোলে, এই জন্য গানের আকর্ষণ মানুষের নিকট এত বেশী। অনুভুতি ছাড়া গানকে গভীরভাবে অনুভব করা যায় না। সঙ্গীত হচ্ছে মানুষের মনের ভাষা।

১। যে কারণে শিক্ষার্থীর শিক্ষা নষ্ট হয়ঃ 

শিক্ষার্থীর সঙ্গীত শিক্ষা নষ্ট হওয়ার প্রধান কয়েকটি কারণ হলো:

১। অধৈর্যতা: ধৈর্যের অভাব থাকলে সঙ্গীত চর্চা কঠিন হয়ে পড়ে।

২। সঙ্গীতের প্রতি গভীর প্রেমের অভাব: অনেক সময় সহজে গান শেখা বা খ্যাতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় অধৈর্য হয়ে পড়া শিক্ষার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।

৩। উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব: সঠিক ও যোগ্য শিক্ষক না থাকলে সঙ্গীত শিক্ষা প্রভাবিত হয়।

৪। পরিবার ও স্থানীয় পরিবেশের নেতিবাচক প্রভাব: যেমন, কোনো ছেলে বা মেয়ে সঙ্গীত চর্চা শুরু করলে পরিবারের লোকজন বা প্রতিবেশীরা সমালোচনা করলে, শিক্ষার্থী ভয়, লজ্জা ও অপমানবোধে গান শেখা বন্ধ করে দিতে পারে।

৫। ভুল রেওয়াজ এবং শারীরিক-মানসিক সমস্যাঃ অতিরিক্ত পরিশ্রম, ভুল রেওয়াজ, অনিদ্রা, কন্ঠরোগ, শরীরের অন্যান্য রোগ, অস্থিরতা এবং অধৈর্যতা অনেক সময় সঙ্গীত শেখার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

২। শিল্পীর অনুভূতি শক্তি

আমরা স্বাদ ও রুচির প্রকাশ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করি এবং প্রকাশ করি। কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পীর কণ্ঠস্বর ও হৃদয়ই সবচেয়ে বেশি অনুভূতির কাজ করে। কর্ণ ও শ্রবণ শক্তি, স্মৃতি ও কল্পনা শক্তি, প্রেমগীতি, ভালোবাসা, ভক্তি, উদারতা, সংযম ইত্যাদি সুক্ষ্ম অনুভূতিগুলো শিল্পীর মধ্যে বেশি কাজ করে। একজন সঙ্গীত শিল্পী হতে হলে সঙ্গীত চর্চার পাশাপাশি এসব আনুষাঙ্গিক বিষয়ের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়।

৩। শ্বাস-প্রশ্বাস

গান গাওয়ার সময় শ্বাস গ্রহণ এবং প্রশ্বাস ছাড়ার নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক সাধারণত দৈনিক ১৮ থেকে ২০ বার শ্বাস-প্রশ্বাস করে। সঙ্গীতশিল্পীকে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত রেওয়াজ পদ্ধতি দ্বারা এই সংখ্যা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হয়।

গান গাওয়ার সময় জিহ্বা, শ্বাসনালী, কণ্ঠস্বর যন্ত্র এবং মুখের ভিতরের অংশগুলো স্বর ও বাণী উচ্চারণে ব্যস্ত থাকে। তখন শ্বাস গ্রহণ নাক দিয়ে বেশি করতে হয় এবং প্রয়োজন অনুসারে বায়ু ছাড়তে হয়। মুখ দিয়ে শ্বাস নিলে গান গাইতে ও উচ্চারণে অসুবিধা হয়।

৪। গলার যত্ন

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। গায়কের সুস্থ কণ্ঠস্বরই তার সবচেয়ে বড় সম্পদ। যাঁর কণ্ঠস্বর নেই, তার গান হয় না। আবার কণ্ঠস্বর থাকলেও যত্নের অভাবে তা নষ্ট হলে গান করার ক্ষমতা ক্ষুণ্ন হয়। শরীর ও কণ্ঠস্বরের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, তাই গায়ককে গলার যত্ন নিতে হবে।

৫। দেহ ও মন

শিল্পীর জন্য দেহ ও মনের সংযম অত্যন্ত জরুরি। অনেক প্রলোভন পরিত্যাগ করেই কণ্ঠে সঙ্গীতের সুর আসে, যা অনেক সাধনার ফল। দেহ ও মনের ভারসাম্য বজায় রাখা সঙ্গীত চর্চার জন্য অপরিহার্য।

৬। ঋতু পরিবর্তন

গরম ও শীত এই দুই প্রধান ঋতু। গরমকালে বেশি রেওয়াজ (অভ্যাস) করা উচিত নয়, কারণ এতে ঘাম হয় এবং সর্দি-কাশির মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। রেওয়াজের পরপর ঠান্ডা জল, বরফজল, আইসক্রীম বা রেফ্রিজারেটরের ঠান্ডা পানি খাওয়া ঠিক নয়।

৭। কণ্ঠস্বর, গায়ক ও গান

যে গান গাইবে, তাকে প্রথমে নিজের কণ্ঠস্বর চিনে নিতে হবে এবং বুঝতে হবে কোন ধরনের গান তার কণ্ঠে সুন্দরভাবে উঠে। কারো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কণ্ঠ ভালো হয়, আবার কারো কণ্ঠ রবীন্দ্র সঙ্গীতের জন্য বেশি উপযোগী হতে পারে।

ভালো-মন্দের এই বিচার গায়কের নিজস্ব অনুভব ও উপযুক্ত শিক্ষকের পরামর্শের ওপর নির্ভর করে। অনেক শিল্পী বিভিন্ন ধরনের গান গাইতে পারদর্শী হন। গানের বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পারদর্শিতা, রুচি ও কণ্ঠস্বর প্রকাশের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে।

৮। কন্ঠস্বর ও স্কেল (Scale)

১। কন্ঠস্বরের স্বাভাবিক প্রকারভেদ অনুসারে স্কেল নির্বাচন করা উচিত।
২। কন্ঠস্বরের স্বাভাবিক গতি, মধ্য ও তার সপ্তকে কন্ঠস্বরের আরোহণ, অবরোহণ ও স্থিতি অনুসারে স্কেল নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
৩। নারী ও পুরুষের কন্ঠস্বরের গঠন ও স্বাভাবিক অবস্থা অনুযায়ী গায়ক ও গায়িকার নিজস্ব কন্ঠস্বরের রেঞ্জ (Range), পিচ (Pitch), ভলিউম (Volume) ও ভর (Weight) অনুসারে স্কেল নির্বাচন ও প্রয়োজনে পরিবর্তন করতে হয়।
৪। গানের বিভিন্ন ধারা, গায়কী ও গানের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে স্কেল নির্বাচন ও প্রয়োজনে পরিবর্তন করা হয়।

৯। ধুমপান
  • যারা কণ্ঠশিল্পী, তাদের জন্য সিগারেট বা ধুমপান থেকে বিরত থাকা শ্রেয়। কারণ নিকোটিন গলার স্বরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
  • এলার্জি থাকা ব্যক্তিদের জন্য ধুমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
  • নস্যি (Snuff), জর্দা পান ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পান মশলা যেমন পান বাহার, পান পরাগ কন্ঠস্বরে ক্ষতি করে।
১০। লিভার ফাংশন ও খাদ্য
  • উগ্র ও গুরুপাক জাতীয় খাবার কণ্ঠশিল্পীদের পরিত্যাগ করা উচিত।
  • বায়ু প্রবাহ থেকে গলার রোগ যেমন ফেরেনজাইটিস, অম্বল, গ্যাটিক হতে পারে যা গলার স্বর নষ্ট করে।
  • খুব ভরা পেটে বা একেবারে খালি পেটে রেওয়াজ (অনুশীলন) করা উচিত নয়।
  • “খানা আউর গানা” প্রবাদটি খাদ্য ও গানের ভারসাম্যের প্রতি ইঙ্গিত করে, অর্থাৎ পেটের অবস্থা বুঝে ও শরীরের পরিমাণ অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। মাংস, ডিম, বিরিয়ানী ইত্যাদি সবকিছুই সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করা দরকার।
১১। চিন্তা ও দুশ্চিন্তা
  • সুচিন্তা শিল্পী ও শিক্ষার্থীকে উন্নতির পথে নিয়ে যায় ও সঙ্গীতে সফল করে।
  • দুশ্চিন্তা মনকে বিভ্রান্ত ও বিক্ষিপ্ত করে, যা সঙ্গীত শিক্ষা ও শিল্প সৃষ্টির পথে বাধা সৃষ্টি করে।
১২। সাধারণ নিয়ম

১। প্রতিদিন সকালে এবং রাতে শোবার আগে নুন জলে গারগেল করা আবশ্যক। নুন জল গলার এন্টিসেপটিক কাজ করে ও কফ দূর করে গলার স্বর ভালো রাখে। তেজপাতা, নিমপাতা বা লবঙ্গ ফুটিয়ে সেই জল দিয়ে গারগেল করলে কণ্ঠস্বর পরিস্কার হয়।
২। ঠান্ডা ও গরম থেকে সাবধান থাকা, অতিরিক্ত কথা বলা ও চিৎকার এড়ানো উচিত। সুরে গান গাইলে গলার স্বর বিকৃত হয় না। দীর্ঘ সময় একসাথে রেওয়াজ করা উচিত নয়।
৩। আবদ্ধ ঘরে রেওয়াজ করা থেকে বিরত থাকা ভালো।
৪। গান গাইবার সময় গলার শিরা বা উপশিরা ফুলে না যাওয়া বা কণ্ঠনালীতে আঘাত না পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
৫। গায়ক বা গায়িকাদের অতিরিক্ত দৈহিক পরিশ্রম করা উচিত নয়। রোদ, বৃষ্টি বা ঠান্ডা থেকে সাবধান থাকতে হবে। বরফ, টক দই, তেঁতুল, অতিরিক্ত ঝাল ইত্যাদি গলার স্বরের জন্য ক্ষতিকর।
৬। খাদ্যগ্রহণে বিশেষ সতর্কতা থাকা প্রয়োজন। এমন খাবার গ্রহণ না করা উচিত যা দেহে বা গলায় এলার্জি সৃষ্টি করতে পারে, যেমন বেগুন, পেঁয়াজ, ডিম, ইলিশ মাছ ইত্যাদি। পেট গরম হওয়া গুরুপাক খাবার এড়ানো উচিত কারণ পেটে বায়ু গলার স্বরের জন্য ক্ষতিকর।
৭। স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য যোগাসন, ব্যায়াম এবং প্রাতঃভ্রমণ গায়ক ও গায়িকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে বাত রোগ ও পেটের আয়তন বৃদ্ধি হতে পারে।
৮। গান গাইবার সময় হারমোনিয়ম বা অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র খুব জোরে বাজানো উচিত নয়, কারণ এতে গলার স্বর চাপা পড়ে। স্বরলিপি অনুসারে হারমোনিয়মের পর্দা বাজানো (Cord effect) দিয়ে গান অভ্যাস করা উচিত।
৯। পুরুষ কন্ঠের ভরাট, গম্ভীর, দরদভরা ও গোল আওয়াজ থাকলে আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের কন্ঠের গান “গায়ক প্রধান” হওয়া উচিত অর্থাৎ গান ও বাণী পুরুষ কণ্ঠের উপযোগী হওয়া প্রয়োজন।
১০। নারী কন্ঠপাতলা ও সুমধুর হলে শ্রুতি মধুর হয়, এজন্য নারী কণ্ঠকে “কোকিল কন্ঠ” বলা হয়। গায়িকাদের গান “নায়িকা প্রধান” হওয়া উচিত অর্থাৎ গানের সুর ও বাণী নারী কণ্ঠের উপযোগী হওয়া উচিত। গায়িকাদের গান বেশি খাদ ও মন্ত্র সপ্তকে না হওয়াই ভালো।

Leave a Comment