Site icon Classical Gurukul [ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গুরুকুল ] GOLN

জমিরউদ্দীন খান । শিল্পী জীবনী

ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খান ছিলেন ‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’ কোম্পানীর প্রধান প্রশিক্ষক। কিন্তু এটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। বাংলার সঙ্গীত সাজতে জমিরউদ্দীন খানের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। বাংলার সঙ্গীত জগৎ যাঁর কাছে বিশেষভাবে ঋণী সে ব্যক্তিটি কিন্তু আদপেই বাঙ্গালী নন। তিনি মূলত পাঞ্জাবী ছিলেন কিন্তু অতি শৈশবেই বাংলাদেশে চলে আসেন এবং পোষাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন, কথা-বার্তা প্রভৃতি সৰ্ব্বক্ষেত্রেই নিজেকে তিনি আদর্শ বঙ্গালী হিসেবে গড়ে তোলেন। জনসমক্ষে তিনি নিজেকে বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন। তাঁর রাজকীয় চেহারা এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যে কোন ব্যক্তিকে অতি অল্প সময়েই তাঁর আপনজনে পরিণত করতে পারতো।

জমিরউদ্দীন খান । শিল্পী জীবনী

বাংলার সঙ্গীত জগতের এক অসামান্য প্রতিভা কাজী নজরুলের সাথে তাঁর ছিল গভীর হৃদ্যতা। নজরুল জমিরউদ্দীনকে নিজের ওস্তাদরূপে বরণ করে নিতে এতটুকু দ্বিধা করেন নি। জমিরউদ্দীনের প্রতি নজরুলের সুগভীর অনুরাগের চিহ্নস্বরূপ কবি তাঁর লেখা ‘বনগীতি’ কাব্যগ্রন্থটি ওস্তাদ জমিরউদ্দীনের নামে উৎসর্গ করেন এবং উৎসর্গ পত্রে লিখেছেন “ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত কলা-বিদ আমার গানের ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খান সাহেবের দত্ত মোবারকে।” শুধু নজরুল নন যাঁদের অসামান্য সুরমাধুর্য্য পরবর্ত্তীকালে বাংলা সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছে।

তাঁদের অধিকাংশ যেমন আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কমলা ঝরিয়া, আব্বাসউদ্দিন প্রমুখ কোন না কোন সময় জমিরউদ্দনি সাহেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় রাগ-সঙ্গীত এবং মুসলিম ঘরনার যে অসামান্য নিকগুলি নজরুলসঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছে তার অনেকখানিই জমিরউদ্দীনের প্রভাবসমৃদ্ধ।

শুধু তাই নয়, নজরুলসঙ্গীতে সুরব্যঞ্জনার যে মোহজাল সৃষ্ট হয়, সুরের যে অনবদ্য রূপে তাঁর গানকে বিশেষ মহিমা দান করে তার মূলে জমিরউদদ্দিন সাহেবের অবদান অনেকখানি। জমিরউদ্দীনের সঙ্গীত পারদর্শিতায় মুগ্ধ নজরুল নিজেকে “ওস্তাদ জমিরউদ্দিনের একজন দীন ভক্ত সাগরেদ” বলে উল্লেখ করেছেন।

ওস্তাদ জমিরউদ্দীনের সঙ্গীত প্রতিভর গুণগ্রাহী ভক্ত নজরুল ওস্তাদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন, “জমিরউদ্দীন খান সাহেব ছিলেন খানদানী গাইয়ে, তিনি ঠুংরী সম্রাট। ওস্তাদ মইজদ্দীন খানের পর তাঁর মত ঠুংরী গাইয়ে আর কেউ ছিলেন না; এখন তো নাই ই ।”

শুধুমাত্র গায়ক হিসাবেই নয় মানুষ হিসাবেও জমিরউদ্দীন ছিলেন আদর্শ স্থানীয়। তাঁর উদার এবং অমায়িক ব্যবহার সকলকে মুগ্ধ করতো। তরুণ এবং উঠতি গায়কদের কাছে তিনি ছিলেন আদর্শ স্থানীয় এবং পরম ভরসাস্থল। সেইযুগে যখন বিভিন্ন সম্প্রদায় বিশেষত: হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে হানাহানি চরম পর্যায়ে তখনও জমিরউদ্দীন খান ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং সমস্ত রকম সঙ্কীর্ণতা, নীচতা ও মলিনতার ঊর্ধ্বে।

তাঁর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে নজরুল বলেছেন, “জমিরউদ্দিন পাঞ্জাবী ছিলেন সত্য, কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন জাতি ও সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে। ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খানের পুত্র আবদুল করীম খানও সঙ্গীত জগতে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। সঙ্গীত রসিক মহলে ওস্তাদ-পুত্র ‘বালী’ নামে সুপরিচিত ছিলেন।

অসামান্য সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খান সাহেব ১৯৩৯ সালের ২৬ নভেম্বর কলকাতাস্থিত বাসাতে পরলোক গমন করেন। এই মৃত্যুর কয়েকদিন বাদে ১০ই ডিসেম্বর এই উপলক্ষে কলকাতায় আয়োজিত এক শোকসভায় সভাপতিত্ব করেন কবি নজরুল স্বয়ং।

এই সভায় কবি নজরুল প্রদত্ত ভাষনের শেষাংশে ছিল, “দেশ যদি স্বাধীন হয়, তবে সেদিন জমিরউদ্দীনের কদর হবে। কিন্তু আমাদের পরবর্তী যুগে আমাদের বংশধরেরা যেন সেদিন মনে করবার অবসর না পায় যে, আমরা নির্বোধ ছিলাম, গুণীর আদর করতে জানতুম না।”

 

দেশ আমাদের স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু কবির প্রত্যাশা অপূর্ণই থেকে গেছে-গুণীর মর্য্যাদা আজও আমরা দিতে শিখিনি। মুষ্টিমেয় কতিপয় সঙ্গীত রসিক ছাড়া অন্যত্র জমিরউদ্দীন খান নামটি অজ্ঞাত ও অপরিচিত প্রায়। বাঙলা সঙ্গীতে জমিরউদ্দীনের অবদানের পূর্ণমূল্যায়নে দেশের সঙ্গীত রসিকদের এখনই এগিয়ে আসা উচিত, অন্যথায় ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে আমরা অপরাধী হয়ে থাকবো।

Exit mobile version