শিল্পী জগৎঘটকঃ বাংলা সঙ্গীত জগতে কাজী নজরুল ইসলাম নি:সন্দেহে একটি চিরস্থায়ী নাম এবং সঙ্গীত বিষয়ে যে কয়েক জন নজরুলের খুক্ষ কাছাকাছি আসার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন শিল্পী জগৎঘটক ছিলেন তাঁদেরই একজন।
শিল্পী জগৎঘটক । শিল্পী জীবনী
বহরমপুর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর নজরুল ঘটক পরিবারের শিক্ষক নলিনাক্ষ সান্যালের বাড়িতে ওঠেন। এই সময় অর্থাৎ ১৯২৪ সালে ঘটক পরিবারের সাথে নজরুলের হৃদ্যতা গড়ে উঠে। পরবর্ত্তীকালে নজরুল কলকাতা চলে আসার কিছুদনি বাদে ঘটক পরিবারও বসবাসের জন্য কলকাতায় চলে আসেন। এরা হলেন ২৪ পরগনা শ্রীমতী সুনীতিবালা, দেবী, বোন গৌরী এবং ছোট ভাই নিতাই ঘটক থাকতেন। কলকাতা আসার পর নজরুলের সাথে জগৎঘটকের সম্পর্ক গভীরতর হয়।
নজরুলের সঙ্গীত রচনা কালের দিকে গবেষকের দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায় তাঁর সঙ্গীত রচনার শ্রেষ্ঠতম সময় হলো বাংলা ১৩৩৯ থেকে ১৩৪৯ সাল। এই সময়ে জগৎ ঘটক মহাশয় সবসময় নজরুলের সঙ্গে থাকতেন এবং কবির রচিত অসংখ্য গান জগৎঘটক মহাশয় কর্তৃক স্বরলিপিকৃত। আত্মমগ্ন খেয়ালী কবি সুরে মায়ায় তন্ময় হয়ে গান রচনা করে যেতেন আর জগৎঘটক মহাশয় গভীর সযত্নে সেগুলি রক্ষা করতেন।
জগৎঘটক ছিলেন মাসিক “ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদক। এই পত্রিকার নজরুলের বহু গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়। জগৎবাবু কলকাতা থাকাকালীন নজরুল তাঁর দিনের অনেকখানি সময় অতিবাহিত করতেন ঘটক মহাশয়ের ৮৭নং কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটের বাড়িতে। এইস্থানেই নজরুল তাঁর বিখ্যাত অনেকগুলি গান রচনা করেন।
নজরুল কলকাতা বেতার কেন্দ্রে যোগাদানের পর ‘হারামনি’ নামে একটি অনুষ্ঠানের প্রচার সুরু করেন। এই অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনায়, সার্থক পাসন প্রকৃতি সৰ্ব্ব ব্যাপারেই জগৎ ঘটক ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এই অনুষ্ঠানের হারিয়ে যাওয়া অপ্রচলিত রাগা রাগিনী প্রকাশিত হত। অনুষ্ঠানটি সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর করতে নজরুলকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় আর এই ব্যাপারে জগৎঘটক ছিলেন তাঁর সর্ব্বক্ষণের সঙ্গী। টুকরো টুকরো কাগজে নজরুল তাঁর গানগুলো রচনা করে যেতেন আর জগতটক অত্যন্ত যত্নসহকারে সেগুলো খাতায় তুলে তার স্বরলিপি রচনা করতেন।
এইভাবে বাংলা গানের এক অনন্য সম্পদ নজরুলসঙ্গীতের সাথে জগৎঘটক নিজের নাম যুক্ত করেন এবং সঙ্গীতরস পিপাসু মানসে বিশেষ একটি স্থান অধিকার করে নেন। নজরুল সঙ্গীত প্রথম স্বরলিপি “নজরুল স্বরলিপি” নামে কালিকা প্রেস কর্তৃক ১৯২৭ কিংবা ‘২৮ সালে প্রকাশিত হয়। পরে এর স্বত্ত্ব কিনে নেন, ‘ডি. এম. লাইব্রেরী’র গোপাল মজুমদার। এই বইয়ের স্বরলিপি প্রস্তুতিতে জগতঘটক মহাশয় প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন। এছাড়া উক্ত বইয়ের চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশ কালে জগৎঘটক মহাশয় এর সংশোধন এবং পরিমার্জ্জন কাজ সুসম্পন্ন করেন।
এইভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিষ্ঠা দ্বারা ঘটক মহাশয় বাংলা অমূল্য সম্পদ “নজরুল সঙ্গীত” লিপিবদ্ধ না করে রাখলে আজ হয়তো আমরা কবি-সৃষ্ট সুরগীতি থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত হতাম। কারন, ভাবপ্রবণ এবং খেয়ালী কবির পক্ষে এ গীতিমঞ্জুষা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হত না। আমরা জানি যে, কবি নজরুলের বহু গান উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে আজ অনিশ্চিতের কোলে হারিয়ে গেছে। সুতরাং এই মহান কর্তব্যপরায়ণ এবং কবিভক্ত জগৎঘটকের কাছে সুরপাগল বাঙ্গালী সমাজ সৰ্ব্বতোভাবে ঋণী ।