‘ঘরানা’ শব্দটি মূলত এসেছে হিন্দি ‘ঘর’ শব্দ থেকে, যার অর্থ পরিবার বা গৃহ। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে ‘ঘরানা’ বলতে বোঝানো হয় সংগীত পরিবেশনের এক একটি স্বতন্ত্র ধারা, যা কোনো একজন বিশিষ্ট সংগীত আচার্য বা গুরুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শিক্ষার মাধ্যমে রীতিমাফিক এগিয়ে চলে। একই গুরুর শিষ্যগণ, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একই সংগীতধারা অনুসরণ করেন—তাদের নিয়েই গঠিত হয় একটি ঘরানা।
হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের ঘরানা
ঘরানার উৎপত্তি ও ইতিহাস
ঘরানার ধারার সূচনা চতুর্দশ শতকের শুরুতে হয়েছে বলে ঐতিহাসিকভাবে অনুমিত হয়। যদিও এর পূর্বেও “কলাবন্ত” এবং “কাওয়াল” নামে সংগীতচর্চার কিছু রীতি প্রচলিত ছিল, সেগুলো সুসংবদ্ধভাবে ঘরানা রূপে গড়ে ওঠেনি। পরবর্তীকালে প্রতিভাধর কোনো সংগীতজ্ঞ যখন প্রচলিত রীতির বাইরে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভঙ্গিতে সংগীত পরিবেশন করেন এবং সেই ধারা তার শিষ্যদের মধ্যে শিক্ষাদানের মাধ্যমে স্থায়ী রূপ দেয়, তখন তা একটি ঘরানায় পরিণত হয়।
ঘরানার বৈশিষ্ট্য ও রীতি
প্রত্যেক ঘরানার থাকে একজন প্রবর্তক গুরু, যার স্বতন্ত্র গায়ন বা বাদনশৈলী দ্বারা সেই ঘরানার স্বরূপ নির্ধারিত হয়। ঘরানার নাম সাধারণত দুইভাবে নির্ধারিত হয়—প্রবর্তকের নাম অনুসারে (যেমন: আমির খসরু ঘরানা), অথবা উৎপত্তিস্থলের নাম অনুসারে (যেমন: বিষ্ণুপুর ঘরানা)। সংগীতচর্চার এই ধারায় গুরুশিষ্য পরম্পরা এবং সৃজনশীল সাধনার সম্মিলনে একটি ঐতিহ্য গড়ে ওঠে।
ঘরানার সাংগীতিক বিশেষত্ব
১. পরম্পরার ভিত্তি: ঘরানা গঠিত হয় গুরুর বংশ এবং তার শিষ্য–প্রশিষ্যদের ধারাবাহিকতায়। এটি শুধুমাত্র আত্মীয়স্বজন নিয়ে গঠিত হয় না।
২. ঐতিহ্য নির্মাতা গুরু: যে সংগীতাচার্য নিজস্ব ধারায় সংগীত পরিবেশন করেন ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে একটি রীতি প্রতিষ্ঠা করেন, তিনিই ঘরানার প্রবর্তক রূপে গণ্য হন।
৩. স্বতন্ত্র রীতি ও ঢঙ: প্রতিটি ঘরানার নিজস্ব গায়ন বা বাদনের রীতি থাকে, যা অন্য ঘরানার চেয়ে ভিন্ন ও স্বাতন্ত্র্যসূচক।
৪. ধারাবাহিকতা: ঘরানা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ঘরানা প্রতিষ্ঠা করেন না; বরং সময়ের ব্যবধানে তা গঠিত হয়।
৫. আঞ্চলিক প্রভাব: ঘরানার উৎপত্তি অনেক সময় নির্দিষ্ট কোনো স্থানে বা গুরুগৃহে হয়। তাই অধিকাংশ ঘরানার নাম সেই স্থান থেকে এসেছে।
৬. নামকরণের রীতি: কোনো কোনো ঘরানার নাম প্রবর্তক গুরুর নাম অনুসারে নির্ধারিত হয়।
৭. শিক্ষাক্রমের স্বাতন্ত্র্য: প্রতিটি ঘরানার নিজস্ব পদ্ধতিতে তালিম দেওয়া হয়, যার ভিত্তিতে একটি সংগীত–পরম্পরা গড়ে ওঠে।
৮. পুরুষানুক্রমিক ঐতিহ্য: খানদানি ঘরানা কয়েক প্রজন্মের সাধনার ফল।
৯. সৃজনশীলতা ও পরিবর্ধন: প্রতিভাবান শিল্পীরা নিজের সাধনার মাধ্যমে ঘরানার সংগীতশৈলীতে নতুনত্ব যোগ করেন, রাগসঙ্গীতকে সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত করে তোলেন।
শাস্ত্রীয় সংগীত ও ঘরানার তাৎপর্য
রাগসঙ্গীত একান্তই গুরুমুখী বিদ্যা। আর এই গুরুমুখী শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘ঘরানা’ ধারণাটির গুরুত্ব অপরিসীম। ঘরানা শুধু একটি গায়ন বা বাদনপদ্ধতির ধারকই নয়, এটি একটি জীবনদর্শন, যা শিষ্যের সঙ্গীতচর্চাকে নির্দিষ্ট কাঠামো ও নীতির মধ্যে পরিচালিত করে। তবে ঘরানার যেমন সুফল রয়েছে, তেমনি কিছু কুফলও আছে। অনেক সময় ঘরানার গণ্ডিতে আবদ্ধ শিল্পীরা মানসিকভাবে সংকীর্ণতায় ভোগেন। ফলে তাঁদের অর্জিত বহু মূল্যবান বিদ্যা তাঁদের মৃত্যু বা নিভৃতচারণের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায়।
তবুও ঘরানা-ভিত্তিক সঙ্গীতচর্চা সাধারণত অনেক উন্নত ও গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট হয়ে থাকে। কারণ, এখানে শিষ্যদের দীর্ঘ সাধনার মধ্য দিয়ে বিদ্যা অর্জন করতে হয়। ঘরানাগত সঙ্গীতচর্চা গোষ্ঠীগতভাবে গড়ে ওঠায় তার মান ও মাত্রা বহু ক্ষেত্রে উঁচুতে উঠে যায়।
ইতিহাসে দেখা যায়, বিভিন্ন যুগে উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বহু ঘরানার জন্ম হয়েছে। আজকের সময়েও ভারতীয় উপমহাদেশের সকল খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞই কোনো না কোনো ঘরানার উত্তরাধিকার বহন করেন।
বিভিন্ন ঘরানার সাথে পরিচয়:
বিষ্ণুপুর ঘরানা: বাংলার গৌরব
বাংলায় ধ্রুপদ সঙ্গীতচর্চার উত্থানে ‘বিষ্ণুপুর ঘরানা’র অবদান অনস্বীকার্য। এ ঘরানার সূচনা ও বিকাশ বাংলা সঙ্গীত ইতিহাসে এক গৌরবজনক অধ্যায়। এখান থেকেই বাংলা ভাষায় ধ্রুপদ রচনা শুরু হয়, যা বাংলা সঙ্গীতের নিজস্ব স্বরূপ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রবর্তক ছিলেন ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ, যিনি তানসেনের বংশধর এবং বিষ্ণুপুর রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের সভাগায়ক ছিলেন। তাঁর কর্মস্থলের নাম অনুসারেই এই ঘরানার নামকরণ করা হয় ‘বিষ্ণুপুর ঘরানা’। এ ঘরানার মূল রীতিনীতি ছিল ধ্রুপদভিত্তিক গায়নশৈলীতে, যা ছিল অত্যন্ত সংযত, সরল ও অলঙ্কারবর্জিত। গমক, কাঁট, মীড়ের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এ ঘরানায় অনুপস্থিত ছিল, ফলে এতে ভাবগাম্ভীর্য অটুট থেকেছে।
রাগব্যবহারে এই ঘরানার কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্যও লক্ষণীয়:
-
বসন্ত রাগে শুদ্ধ ধৈবতের প্রাধান্য,
-
ভৈরব রাগের অবরোহণে কোমল নিষাদের সংস্পর্শ,
-
রামকেলীতে কড়ি মধ্যমের বর্জন,
-
পূরবীতে শুদ্ধ ধৈবত ও
-
বেহাগে কোমল নিষাদের ব্যবহার—এসবই বিষ্ণুপুর ঘরানাকে অন্য ঘরানার থেকে পৃথক করে তোলে।
তাল ও ছন্দবিন্যাসেও এই ঘরানার স্বকীয়তা বিদ্যমান।
এই ঘরানার উল্লেখযোগ্য সঙ্গীতজ্ঞদের মধ্যে ছিলেন:
-
রামশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়,
-
গঙ্গাধর চক্রবর্তী,
-
অনন্তলাল চক্রবর্তী,
-
অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়,
-
যদুভট্ট,
-
ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী,
-
বাঠিকামোহন গোস্বামী,
-
গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়,
-
রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়,
-
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং
-
রামকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই বিশিষ্ট সাধকগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং ধারাবাহিক সাধনার ফলে বিষ্ণুপুর ঘরানা কালের স্রোতে আজও তার গৌরব ধরে রেখেছে।
এমদাদ খাঁ ঘরানা
এমদাদ খাঁ ঘরানা মূলত সেতার ও সুরবাহারকে কেন্দ্র করে গঠিত একটি বিশিষ্ট ঘরানা। এর উৎপত্তি উনিশ শতকের শেষভাগে মধ্য ভারতে। এই ঘরানার সংগীতচর্চার ধারায় বিশেষ অবদান রাখেন এমদাদ খাঁর পুত্র, প্রখ্যাত সেতারশিল্পী এনায়েত খাঁ।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সভাসঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় এনায়েত খাঁ এই ঘরানার ধারাকে প্রাণবন্তভাবে চর্চা করেন ও প্রসার ঘটান। গৌরীপুর থেকেই তিনি একটি বিশিষ্ট শিষ্যসমাজ গড়ে তোলেন এবং এমদাদ খাঁ ঘরানার সংগীতধারা উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেন।
এই ঘরানার বাদনশৈলীতে দৃষ্টিনন্দন রাগ-উপস্থাপনা, সূক্ষ্মতা, ভাবগম্ভীরতা এবং সুরবাহার ও সেতারের মেলবন্ধনের নিখুঁত ছাপ লক্ষ করা যায়। এনায়েত খাঁর সাধনা ও শিক্ষাদানের মাধ্যমেই এই ঘরানাটি সংগীতজগতের এক গৌরবময় পরম্পরায় পরিণত হয়।
সেনী-মাইহার ঘরানা
সেনী-মাইহার ঘরানা হলো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি স্বতন্ত্র ও প্রভাবশালী ধারা, যার প্রবর্তক ছিলেন বাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিবপুর গ্রামের বিশ্ববরেণ্য সংগীতাচার্য ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তাঁর সংগীত শিক্ষার গুরু ছিলেন ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ, যিনি ছিলেন তানসেনের জামাতা বংশীয় মিশ্রী খাঁ বা নৌবত খাঁর শিষ্য এবং রামপুর রাজ্যের নবাব হামেদ আলী খাঁর সভাসঙ্গীতজ্ঞ।
সংগীত শিক্ষাজীবন শেষে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মাইহার রাজ্যের মহারাজা ব্রিজনারায়ণের রাজসভায় সংগীতজ্ঞ হিসেবে নিয়োজিত হন এবং সেখানেই আমৃত্যু স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তাঁর নিজস্ব গায়ন ও বাদনরীতি এবং শিষ্য-প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একটি নতুন সংগীতধারা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। গুরুর পারিবারিক পরিচয় (সেনী) এবং তাঁর কর্মস্থল (মাইহার)–এই দুই উপাদান মিলিয়ে তাঁর সৃষ্ট ঘরানাটি পরিচিতি পায় ‘সেনী-মাইহার ঘরানা’ নামে।
এই ঘরানা থেকে রবি শঙ্কর, আলী আকবর খাঁ, নিকহিল বন্দ্যোপাধ্যায়, শরণ রানি, অন্নপূর্ণা দেবী প্রমুখ বহু কিংবদন্তি শিল্পীর জন্ম হয়েছে, যাঁরা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছেন।
সেনী-মাইহার ঘরানার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সরোদ ও সেতার বাদনের এক অভূতপূর্ব সমন্বয়। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ভারতবর্ষের বিভিন্ন ঘরানার গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, তাদের বাদনরীতির নির্যাস একত্র করে নিজস্ব একটি অনন্য বাজ (বাদন-পদ্ধতি) সৃষ্টি করেন। তিনি সরোদে বিভিন্ন যন্ত্রের—যেমন রবাব, বীণা, সুরসৃঙ্গার, সেতার ও সুরবাহার—বাজাবার ঢং ও ভাবধারা সংমিশ্রণ করে একটি নতুন ধারার সরোদবাদন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর বাজে আলাপ, জোড়, ঝালা এবং গৎ-এর সুসংবদ্ধ অনুক্রম লক্ষ করা যায়।
তিনি সরোদে ‘ডারা-ডারা’ এবং ‘রাডা-রাড়া’ প্রয়োগের শুদ্ধ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে বাজকে আরও শক্তিশালী, প্রাণবন্ত ও কুশলী করে তোলেন। এই ঘরানার বাজে অলঙ্করণ ও ছন্দবিন্যাসে একধরনের বিজ্ঞানসম্মত ভারসাম্য থাকে, যা শ্রোতার মনকে গভীরভাবে আন্দোলিত করে।
সেনী-মাইহার ঘরানার বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
-
সরোদ ও সেতারের ভাবধারা একীভূত করা
-
‘ডারা-ডারা’ ও ‘রাডা-রাড়া’ প্রয়োগে বিশিষ্টতা
-
ঝালা বাজাবার ধারা ও প্রযুক্তিতে পরিবর্তন
-
মিশ্ররাগের সৃষ্টি ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রয়োগ
-
তারপরনের (taan pattern) অভিনব রূপায়ণ
-
বাদনের পাশাপাশি রচনাশৈলীতেও অভিনবত্ব
এই ঘরানার সংগীত বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে চর্চিত ও সমাদৃত।
সেনী-মাইহার ঘরানার বিশিষ্ট শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলো হল:
ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খান, পণ্ডিত তিমিরবরণ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, অন্নপূর্ণা দেবী (রওশন আরা বেগম), ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান, ওস্তাদ আলী আহমদ খান, ওস্তাদ খাদেম হোসেন খান, ওস্তাদ ফুলঝুরি খান, ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান, ওস্তাদ মীর কাশেম খান, ওস্তাদ খুরশীদ খান, পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত ভি.জি. যোগ, বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, শ্যামকুমার গাঙ্গুলী, শরণরাণী, শিশিরকণা ধর চৌধুরী, আশীষ খান, ধ্যানেশ খান, শাহাদত হোসেন খান, রীনাত ফওজিয়া, ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য, শ্রীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্তোষ পরমাণিক, দ্যুতিকিশোর আচার্য চৌধুরী প্রমুখ।
নিয়ামতউল্লাহ্ খাঁর সরোদ ঘরানা
নিয়ামতউল্লাহ্ খাঁর সরোদ ঘরানার সূচনা হয় উনিশ শতকের শেষভাগে উত্তর ভারতে। তিনি কাবুলি রাবাবকে সংস্কার করে সরোদ নির্মাণের পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত হন। তাঁর অনন্য বাদনশৈলী, গৎ ও তোড়ায় শৈল্পিক অভিনবতা, এবং নিখুঁত রচনাভঙ্গি সরোদের জগতে এক নতুন ধারার সূচনা করে। এই ধারাই পরিচিত হয় “নিয়ামতউল্লাহ্ খাঁর সরোদ ঘরানা” নামে।
নিয়ামতউল্লাহ্ খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র—কেরামতউল্লাহ্ খাঁ ও আসাদউল্লাহ্ খাঁ কৌকভ (অথবা কৌকভ খাঁ)—পিতৃপ্রতিষ্ঠিত ঘরানার উত্তরাধিকার বহন করেন। তাঁদের মাধ্যমেই এ ঘরানার প্রবাহ বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। বিশ শতকের শুরুতে কৌকভ খাঁ কলকাতায় বসবাস শুরু করেন এবং আমৃত্যু এ ঘরানার চর্চা ও প্রসারে নিজেকে নিবেদিত রাখেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিষ্যদের মধ্যে ধীরেন্দ্রনাথ বসু ও সাখাওয়াৎ হোসেন বিশেষভাবে স্মরণীয়।
কৌকভ খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভাই কেরামতউল্লাহ্ খাঁ ঘরানার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একটি বিশাল শিষ্যমণ্ডলী গড়ে তোলেন এবং নিয়ামতউল্লাহ্ ঘরানার সংগীতধারা অব্যাহত রাখেন। তাঁর প্রচেষ্টায় এই ঘরানাটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে একটি মর্যাদাসম্পন্ন স্থান অধিকার করে।
গয়া ঘরানা
গয়া ঘরানা মূলত খেয়াল ও এসরাজবাদনের এক স্বতন্ত্র সংগীতধারা, যার প্রবর্তক ছিলেন হরিসিং ও তাঁর পুত্র হনুমান দাস সিং। এ ঘরানার উদ্ভব উনিশ শতকের মধ্যভাগে। শতকের শেষভাগে হরিসিং ও হনুমান দাসের শিষ্য কানাইলাল ঢেঁড়ীর মাধ্যমে গয়া ঘরানা কলকাতাসহ সমগ্র বাংলায় বিস্তৃত হয়। কানাইলাল ছিলেন একপ্রকার এসরাজ-সাধক, যিনি কলকাতার অমৃতলাল দত্ত, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অরুণেন্দ্রনাথ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে এসরাজ শিক্ষা দেন।
পরে হনুমান দাসের পুত্র মোহনদাস গয়া ঘরানায় ঠুমরি ও হারমোনিয়ামবাদন অন্তর্ভুক্ত করে এর পরিসর ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করেন। গয়া ঘরানার সংগীতে খেয়ালের চমৎকার বন্দিশ, সুস্পষ্ট ও বোধগম্য বাণী, সুরের মাধুর্য, এবং এসরাজে খেয়াল অঙ্গের জোড়, তান ও ঝালা সহযোগে সংগীত পরিবেশন এই ঘরানার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত।
গোলাম আলীর সরোদ ঘরানা:
গোলাম আলীর সরোদ ঘরানা প্রতিষ্ঠিত হয় উনিশ শতকের শেষভাগে উত্তর ভারতে, বিশিষ্ট সরোদবাদক গোলাম আলীর মাধ্যমে। তিনি প্রথাগত কাবুলী রবাবকে পরিবর্ধন ও সংস্কারের মাধ্যমে সরোদের আধুনিক রূপ প্রদান করেন এবং নিজস্ব বাদনরীতির মাধ্যমে এই ঘরানার সূচনা করেন। এই ঘরানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গৎ বা বাঁধা সুরভিত্তিক রচনার দক্ষ পরিবেশনা।
গোলাম আলীর তিন পুত্রই সরোদবাদনে পারদর্শী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে মুরাদ আলীর পালকপুত্র আবদুল্লাহ্ খাঁর মাধ্যমে এই ঘরানার প্রবেশ ঘটে বাংলায়। তিনি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর এবং তাঁর পুত্র বীরেন্দ্রকিশোরকে সরোদের তালিম দেন। আবদুল্লাহ্ খাঁর পুত্র আমীর খাঁ রাজশাহীর তালন্দ, গৌরীপুর ও কলকাতায় এক বিশাল শিষ্যপরম্পরা গড়ে তোলেন এবং এ ঘরানার বিস্তার ঘটান। মূলত আমীর খাঁর নিষ্ঠ সাধনা ও প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই গোলাম আলী ঘরানা বাংলার সংগীতজগতে ব্যাপক পরিচিতি ও মর্যাদা লাভ করে।
ডাগর ঘরানা:
ডাগর ঘরানা প্রাচীন ধ্রুপদ ঘরানাগুলোর অন্যতম। এই ঘরানার নাম এসেছে ‘ডাগর বাণী’ ধ্রুপদ পরিবেশনের কারণে। যদিও এর ইতিহাস সঠিকভাবে জানা কঠিন, তবে ১৮শ শতকের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ বহরম খাঁ ও তাঁর পিতার যুগ থেকে এই ঘরানার উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান রূপে ডাগর ঘরানার ভিত্তি বহরম খাঁর সময় থেকেই গড়ে ওঠে।
প্রথমদিকে এই ঘরানার কেন্দ্র ছিল রাজস্থানের জয়পুর, পরে তা স্থানান্তরিত হয়ে উদয়পুরে অবস্থান লাভ করে। ডাগর ঘরানার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিলেন নাসিরুদ্দিন। তাঁর দুই পুত্র নাসির মৈনুদ্দীন ডাগর ও নাসির আমিনুদ্দীন ডাগর ‘ডাগর ভ্রাতা’ নামে সুপরিচিত হন। তাঁদের অসাধারণ প্রতিভায় তারা বিদেশেও সংগীত পরিবেশন করে ডাগর ঘরানার জনপ্রিয়তা বাড়ান।
বাংলায় ডাগর ঘরানার সূচনা হয় আল্লাবন্দের পুত্র নাসিরুদ্দীনের মাধ্যমে। তাঁর মৃত্যুর পরে নাসির আমিনুদ্দীন ঘরানার ধারাকে আরও বিস্তৃত করেন। ডাগর ঘরানার ধ্রুপদ গভীর ভক্তিমূলক এবং শাস্ত্রসম্মত। কথিত আছে, এই ঘরানায় মোট ৫২ প্রকার অলঙ্কার ব্যবহৃত হয়। এছাড়া, ডাগর ঘরানায় বীণাবাদন এবং যুগলবন্দী ধ্রুপদ পরিবেশন করাও প্রচলিত।
প্রসদ্দু-মনোহর ঘরানা:
প্রসদ্দু-মনোহর ঘরানা উনিশ শতকের প্রথম ভাগে উত্তর ভারতের বারাণসীতে উদ্ভূত একটি স্বতন্ত্র সংগীতধারা। এই ঘরানার নামকরণ হয়েছে বারাণসীর দুই ভাই, হরিপ্রসাদ মিশ্র ও মনোহর মিশ্রের নামানুসারে। এই ঘরানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তাল এবং লয়ের প্রতি গভীর দৃষ্টি ও কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রবাদনে দক্ষতা।
যদিও ঘরানাটি বারাণসীতে জন্ম গ্রহণ করলেও এর পূর্ণ বিকাশ ঘটে কলকাতায়, বিশেষত প্রসদ্দু ও মনোহরের যুগে। পরবর্তী প্রজন্মের উত্তরসূরিরা বাংলায় এ ঘরানার সংগীত ঐতিহ্য বিস্তার করেন এবং এটি বাংলার সঙ্গীতাঙ্গনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাংলার উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা, যেমন মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এই ঘরানার খ্যাতিকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন।
ফররুখাবাদ তবলা ঘরানা:
ফররুখাবাদ তবলা ঘরানার প্রবর্তক ছিলেন বিলায়েত আলী বা হাজী বিলায়েত আলী। উনিশ শতকের মধ্যভাগে উত্তরপ্রদেশের ফররুখাবাদে এই ঘরানার সূচনা ঘটে। বিখ্যাত তবলাবাদক আহমদজান থিরাকুয়ার মাধ্যমে ফররুখাবাদ ঘরানার প্রভাব বাংলায় প্রবেশ করে এবং চুনীলাল গঙ্গোপাধ্যায়, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষসহ তাঁদের শিষ্য-প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মাধ্যমে বাংলায় ব্যাপক প্রসার লাভ করে।
ফররুখাবাদ ঘরানার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে কায়দা ও রেলার সূক্ষ্ম প্রয়োগ, খোলা ও জোরদার বোলের ব্যবহার, পাশাপাশি কিছু কিছু নাচের বোলের প্রয়োগ। এই রীতিনীতির মাধ্যমে ঘরানাটি তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে তবলার শিল্পজগতে অনন্য স্থান অধিকার করে।
বারাণসী তবলা ঘরানা:
বারাণসী তবলা ঘরানার সূচনা হয় উনিশ শতকের শেষ ভাগে রামসহায়ের দ্বারা এবং তাঁর শিষ্যপরম্পরায় এটি স্বতন্ত্র একটি ঘরানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ঘরানায় তবলার সঙ্গে পাখোয়াজ, ঢোল, এবং নাকাড়া বাদ্যের বোল ও রীতির মিশ্রণ লক্ষণীয়। এছাড়াও, কত্থক নৃত্যসঙ্গীত, মন্ত্র, শ্লোক প্রভৃতির আবৃত্তির ছন্দ ও তাল অনুসরণ করাই এই ঘরানার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
প্রখ্যাত তবলাবাদক মৌলবিরাম এই ঘরানার মাধ্যমে বারাণসী তবলা সঙ্গীতকে বাংলায় জনপ্রিয় করেন। তিনি দীর্ঘদিন বাংলায় থেকে শিষ্যমণ্ডলী গড়ে তবলার শিক্ষা দিয়েছেন এবং ঘরানাটির প্রসার ঘটিয়েছেন।
বারাণসী তবলা ঘরানার প্রসিদ্ধ তবলাবাদকগণের মধ্যে অমৃতলাল মিশ্র, মহাপুরুষ মিশ্র, কিষেণ মহারাজ, আনোখেলাল, হরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, ও আশুতোষ ভট্টাচার্য অন্যতম।
বারাণসী মিশ্র ঘরানা:
বারাণসী মিশ্র ঘরানার জন্ম ঘটে উনিশ শতকের প্রথম ভাগে বারাণসীতে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বুদ্ধু মিশ্র। এই ঘরানার বিশেষত্ব হলো সারঙ্গীবাদন ও খেয়াল ও টপ্পা গায়নের অনন্য মিশ্রণ, যার কারণে এটিকে ‘মিশ্র ঘরানা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীকালে এই ঘরানায় তবলাবাদনের অন্তর্ভুক্তিও ঘটে, যা এর সঙ্গীত পরিবেশনকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।
বুদ্ধু মিশ্রের পুত্র বেচু মিশ্রের মাধ্যমে বারাণসী মিশ্র ঘরানা বাংলায় ব্যাপক প্রসার লাভ করে। বাংলার কিছুমাত্র উল্লেখযোগ্য শিল্পী, যেমন রামপ্রসাদ, শরৎ চট্টোপাধ্যায়, রামনারায়ণ চৌধুরী প্রমুখ এই ঘরানার প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং এ ঘরানাকে সমৃদ্ধ করেছেন।
বেতিয়া ঘরানা:
বেতিয়া ঘরানা ভারতের এক বিশেষ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ঘরানা, যার উদ্ভব ঘটেছে উনিশ শতকের প্রথম ভাগে বিহারের বেতিয়া রাজ্যের রাজদরবারকে কেন্দ্র করে। এই ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ধ্রুপদ শিল্পী রাজা আনন্দকিশোর। তাঁর সঙ্গীতচর্চা ও উৎসাহে বেতিয়া ঘরানা সুসংগঠিত রূপ ধারণ করে।
বেতিয়া ঘরানা বাংলায় পৌঁছে গুরুপ্রসাদ মিশ্র ও শিবনারায়ণ মিশ্র ভ্রাতৃদ্বয়ের মাধ্যমে, যাঁরা এ ঘরানার ধারাকে বাংলার মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলাই এক পর্যায়ে এই ঘরানার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। লালচাঁদ বড়াল, সতীশচন্দ্র দত্ত, নওলকিশোর প্রমুখ প্রখ্যাত শিল্পীরা বেতিয়া ঘরানার নাম ও খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
বেতিয়া ঘরানার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর সুরের গভীরতা ও বিস্তারমূলক গায়নপদ্ধতি, যা শ্রোতাদের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে। এই ঘরানার গায়নশৈলী রাগের সূক্ষ্মতম আবহকে জাগ্রত করে ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে।
রামপুর ঘরানা:
রামপুর ঘরানা প্রতিষ্ঠিত হয় উনিশ শতকের মধ্যভাগে রামপুর দরবারের পৃষ্ঠপোষকতায়। এই ঘরানার জন্ম তানসেন বংশীয় সঙ্গীতজ্ঞদের প্রভাবেই হয়েছে, তাই একে সেনী ঘরানারই একটি রূপান্তর হিসেবেই গণ্য করা হয়। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মাধ্যমে রামপুর ঘরানা বাংলায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়।
সেনী বংশের বিশিষ্ট সরোদ শিল্পী দবীর খাঁ ছিলেন এই ঘরানার একজন প্রখ্যাত প্রতিনিধি, যিনি রামপুর ঘরানার সঙ্গীত প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিখ্যাত সুরবাহার শিল্পী ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁও রামপুর ঘরানার সঙ্গীত বাংলাদেশে প্রসার ও প্রচারে বিশেষ অবদান রেখেছেন।
সরোদবাদক ফিদা হোসেন, সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খান প্রমুখ শিল্পীরাও রামপুর ঘরানার অনুসারী ছিলেন। এই ঘরানার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পদ্ধতিগত সম্পূর্ণতা, ধ্রুপদী মেজাজ এবং শ্রুতিমাধুর্যের সুসমন্বয়, যা রামপুর ঘরানাকে অন্যান্য ঘরানার থেকে স্বতন্ত্র ও শ্রুতিমধুর করে তোলে।
লক্ষ্ণৌ তবলা ঘরানা:
লক্ষ্ণৌ তবলা ঘরানা মূলত লক্ষ্ণৌর রাজদরবার থেকে উদ্ভূত। এই ঘরানার স্রষ্টা হিসেবে পরিচিত হন হোসেন বখসু মিঞা, যিনি আঠারো শতকের শেষ দিক অথবা উনিশ শতকের প্রথম ভাগে এ ঘরানার ভিত্তি স্থাপন করেন।
লক্ষ্ণৌর নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ্ ইংরেজ শাসনের কারণে কলকাতার পার্শ্ববর্তী মেটিয়াবুরুজে নির্বাসিত হওয়ার পর তাঁর দরবারে যোগ দেন বখসুর পৌত্র ছোটে মিঞা ও তাঁর পুত্র বাবু খাঁ। এঁদের মাধ্যমেই লক্ষ্ণৌ তবলা ঘরানার পরিচিতি এবং সঙ্গীতধারা বাংলায় বিস্তার লাভ করে।
এই ঘরানার বিশিষ্ট শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন আবেদ হোসেন খাঁ, নগেন্দ্রনাথ বসু, মণিলাল মিত্র, ইনায়েত উল্লাহ এবং হীরেন্দ্রকুমার। লক্ষ্ণৌ তবলা ঘরানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কত্থক নৃত্যসঙ্গীতের সঙ্গে এর নিবিড় সম্পর্ক, ঠুমরির মিষ্টি ছন্দ, এবং ধীরে ধীরে কেটে বোলের প্রাচুর্যপূর্ণ আবহ।
এই সকল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্ণৌ ঘরানার সঙ্গীত পরিবেশনে এক বিশেষ অনুষঙ্গ সৃষ্টি করে যা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে আসছে যুগের পর যুগ।
শাহ্জাহানপুর সরোদ ঘরানা:
শাহ্জাহানপুর সরোদ ঘরানা প্রবর্তক ছিলেন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ এনায়েত আলী খাঁ। ঘরানাটির নামকরণ হয়েছে তাঁর উৎপত্তিস্থল শাহ্জাহানপুরের নামে। এনায়েত আলী খাঁ তানসেনের কন্যাবংশীয় নির্মল শাহর কাছে সংগীত শিক্ষা লাভ করেন, তাই এই ঘরানাকে সেনী ঘরানার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তার পিতা নিয়ামতউল্লাহ্ কাবুলী রবাব যন্ত্রের সংস্কার করে সরোদ বাদ্যযন্ত্রের প্রবর্তন করেন। এনায়েত আলী সেই সংস্কারের ভিত্তিতেই নিজস্ব সরোদ ঘরানা প্রতিষ্ঠা করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি ঢাকার ভাওয়াল রাজদরবারে যোগ দিয়ে সেখানেই সঙ্গীতচর্চায় নিয়োজিত থাকেন এবং আমৃত্যু সেখানেই তাঁর সঙ্গীতজীবন সম্পন্ন হয়।
শাহ্জাহানপুর সরোদ ঘরানার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর ধ্রুপদাঙ্গের বাদনশৈলী, যা এই ঘরানাকে বিশেষ ও স্বতন্ত্র করে তোলে। পরবর্তীতে এই ঘরানা বাংলায় ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে এবং বহু শিষ্য-প্রম্পরা গড়ে ওঠে।
উপর্যুক্ত ঘরানাসমূহ ছাড়াও আরও অনেক ঘরানার সঙ্গীত ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। সেগুলোর মধ্যে আমীর খাঁ ঘরানা, সেনী ঘরনা, আগ্রা ঘরনা, কিরাণা ঘরানা, জয়পুর ঘরনা, পাতিয়াল ঘরনা, দিল্লী ঘরানা, আল্লাদিয়া খাঁ ঘরানা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ঘরানা কেবল সংগীত পরিবেশনের একটি শৈলী নয়, এটি এক ধরনের সাংগীতিক জীবনধারা—যার মধ্যে আছে গুরু–শিষ্য পরম্পরার প্রতি শ্রদ্ধা, ধারাবাহিক সাধনার ঐতিহ্য এবং সৃজনশীলতার অবিরাম প্রবাহ। সংগীতপ্রেমীদের জন্য ঘরানা হচ্ছে শ্রদ্ধা ও সাধনার এক অমূল্য উত্তরাধিকার।
আরও দেখুন: