শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চার মূলভিত্তি হলো সঠিক স্বরচিন্তা ও শ্রুতিগ্রহণ। আর এই সঠিক চর্চার জন্য প্রথম ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো— বিভিন্ন সপ্তকের স্বরগুলিকে সঠিকভাবে চেনা ও আলাদা করা। সপ্তক মানে হলো স্বরের এক সম্পূর্ণ ধারা, যা সাধারণত তিনটি ভাগে বিভক্ত— মন্দ্র (নিচু), মধ্য (স্বাভাবিক), ও তার (উচ্চ)। এই তিনটি স্তরে একই স্বর ভিন্ন উচ্চতায় ধ্বনিত হয়, এবং প্রত্যেকটির ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য আলাদা।
অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক পর্যায়ে এই স্বরগুলোর পার্থক্য বুঝতে হিমশিম খান। কখনো মন্দ্র সা আর মধ্য সা এক মনে হয়, আবার তার সপ্তকের স্বরকে অতিরিক্ত তীক্ষ্ণ মনে হতে পারে। সঠিক শ্রবণ, অনুশীলন এবং কিছু নির্দিষ্ট কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা সহজেই বিভিন্ন সপ্তকের স্বর চিনে নিতে পারি।
বিভিন্ন সপ্তকের স্বর চিনবার উপায়
সপ্তক
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ‘সপ্তক’ বলতে বোঝানো হয় স্বরের একটি পূর্ণাঙ্গ ধারা, যেখানে সা থেকে শুরু করে পুনরায় উচ্চ সা (র্শা) পর্যন্ত সাতটি মৌলিক স্বর (সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি) এক ধারাবাহিকতায় সংগঠিত থাকে। সাধারণভাবে তিনটি প্রধান সপ্তক রয়েছে:
১. উদারা বা মন্দ্র সপ্তক (নিম্ন সপ্তক)
২. মুদারা বা মধ্য সপ্তক (মাঝের সপ্তক)
৩. তারা বা তার সপ্তক (উচ্চ সপ্তক)
প্রতিটি সপ্তকের স্বর আলাদা উচ্চতায় ধ্বনিত হয় এবং লিখিত রূপেও তাদের আলাদা চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১। উদারা বা মন্দ্র সপ্তক (নিম্ন স্বর)
- চেনার উপায়: স্বরের পাশে হসন্ত (্) চিহ্ন যুক্ত থাকে।
- উদাহরণ: স্, র্, গ্, ম্, প্, ধ্, ন্
- ব্যবহার: এই স্বরগুলো সাধারনত গলার নিচু স্বরে ধ্বনিত হয়। পুরুষ কণ্ঠে এরা ভারী ও গভীরভাবে উচ্চারিত হয়।
- ব্যবহারিক কৌশল: গলার গভীরে বা বুকে অনুভূত হয় এমন ভাবে গাইলে সাধারণত মন্দ্র স্বরের অনুভব পাওয়া যায়।
২। মুদারা বা মধ্য সপ্তক (প্রধান স্বর)
- চেনার উপায়: এই সপ্তকের স্বরগুলোতে কোনো চিহ্ন থাকে না।
- উদাহরণ: সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি
- ব্যবহার: সাধারণত এই সপ্তকের স্বরগুলোতেই গানের মূল সুর চলমান থাকে। অধিকাংশ রাগ এই সপ্তকের মধ্যেই পরিবেশিত হয়।
- ব্যবহারিক কৌশল: কথাবলার স্বাভাবিক উচ্চতায় এই স্বরগুলো অনায়াসে গাওয়া যায়।
৩। তারা বা তার সপ্তক (উচ্চ স্বর)
- চেনার উপায়: স্বরের ওপরে ‘রেফ’ (র্) চিহ্ন যুক্ত থাকে।
- উদাহরণ: র্সা, র্রে, র্গা, র্মা, র্পা, র্ধা, র্নি
- ব্যবহার: এদের উচ্চারণ গলার ওপরের দিকে বা মাথার দিকে অনুভূত হয়। তারা সপ্তক উচ্চস্বরে তীব্র ও তীক্ষ্ণভাবে ধ্বনিত হয়।
- ব্যবহারিক কৌশল: কণ্ঠসাধনার মাধ্যমে গলার ওপরের অংশে বা কপালের ভেতর দিকের অনুরণনে এই স্বরগুলো উপলব্ধ করা যায়।
অতিরিক্ত টিপসঃ
- শ্রুতি সাধনার মাধ্যমে বিভিন্ন সপ্তকের পার্থক্য নিরূপণ করা যায়।
- হারমোনিয়াম বা তানপুরা ব্যবহার করে একই স্বর তিনটি সপ্তকে বাজিয়ে শোনার মাধ্যমে শ্রবণক্ষমতা বাড়ানো যায়।
- ধীরে ধীরে সরগম অনুশীলনের সময় তিনটি সপ্তকে ‘সা রে গা মা পা ধা নি সা’ গেয়ে তুলনা করলেই পার্থক্য স্পষ্ট হয়।
- গুরু বা প্রশিক্ষকের নির্দেশনার মাধ্যমে শ্রবণের সূক্ষ্ম পার্থক্য অনুধাবন করা যায়।
🎵 সুরের আরোহন ও অবরোহন
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সুরের চলন বা গতিপথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত একটি রাগের কাঠামো নির্ধারণে আরোহন (উর্ধ্বগতি) ও অবরোহন (অধোগতি) — এই দুটি পথ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। চলুন এ দুটি ধারণা স্পষ্টভাবে বুঝে নিই।
🔺 আরোহন (Arohan)
আরোহন বলতে বোঝানো হয়— নিচু সুর থেকে উঁচু সুরে যাওয়া, অর্থাৎ স্বরের ক্রমধারায় ওপরের দিকে ওঠা।
এটি মূলত সুরের উর্ধ্বগামী প্রবাহ, যা রাগের আবহ সৃষ্টি করে ধীরে ধীরে চূড়ায় পৌঁছায়।
📌 উদাহরণ:
সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি, সাʼ
এখানে সা থেকে শুরু করে তার সাʼ পর্যন্ত স্বরধারা উর্ধ্বগামী।
🔻 অবরোহন (Avarohan)
অবরোহন হলো— উঁচু সুর থেকে নিচের সুরে নামা, অর্থাৎ স্বরের ক্রমধারায় নেমে আসা।
এটি সুরের নিম্নগামী প্রবাহ, যা রাগকে শান্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ রূপ দেয়।
📌 উদাহরণ:
র্সা, নি, ধা, পা, মা, গা, রে, সা
এখানে তার সাʼ থেকে শুরু করে মূল সা পর্যন্ত সুরের অধোগতি লক্ষ্য করা যায়।
🪕 প্রয়োগে গুরুত্ব
- অনেক রাগে আরোহন ও অবরোহন আলাদা আলাদা নিয়ম অনুসরণ করে।
- কিছু রাগে স্বরসংখ্যা ও ব্যবহৃত স্বর ভিন্ন হয় আরোহন ও অবরোহনে।
- রাগের চরিত্র গঠনে এই গতিপথ মুখ্য ভূমিকা রাখে।
🎼 বিভিন্ন ধরণের স্বর ও স্বরবিন্যাস
ক্র. | বিষয় | বর্ণনা |
১। | সরগম | রাগ-ভিত্তিক তালবদ্ধ স্বরবিন্যাসকে সরগম বলা হয়। |
২। | স্বর | সঙ্গীত উপযোগী শ্রুতি মধুর আওয়াজকে স্বর বলা হয়। স্বর দুই প্রকার: শুদ্ধস্বর ও বিকৃতস্বর। |
৩। | শুদ্ধস্বর | সঙ্গীতে অবিকৃত স্বর। যেমন: সা, রা, গা, মা, পা, ধা, না। |
৪। | বিকৃতস্বর | শুদ্ধ অবস্থা থেকে উচ্চ বা নিম্ন গতিতে পরিবর্তিত স্বর (কোমল বা তীব্র)। যেমন: ঝা, জ্ঞা, হ্মা, দা, ণা। |
৫। | সচলস্বর | যে স্বর রূপান্তরিত হতে পারে। যেমন: রা, গা, মা, ধা, না (শুদ্ধ ও কোমল উভয় রূপে)। |
৬। | অচলস্বর | যে স্বর বিকৃত হয় না বা অপরিবর্তনীয়। যেমন: সা, পা। |
৭। | তীব্রস্বর | শুদ্ধ অবস্থা থেকে উচ্চ গতিতে পরিবর্তিত স্বর। যেমন: হ্মা (১টি)। |
৮। | কোমলস্বর | শুদ্ধ অবস্থা থেকে নিম্ন গতিতে পরিবর্তিত স্বর। যেমন: ঝা, জ্ঞা, দা, ণা (৪টি)। |
৯। | গ্রহস্বর | যে স্বর থেকে গান শুরু হয়। |
১০। | বাদীস্বর | যে স্বরটি রাগে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। |
১১। | সমবাদীস্বর | বাদীস্বরের পরেই যে স্বর রাগে মুখ্যভাবে ব্যবহৃত হয়। |
১২। | অনুবাদীস্বর | বাদী ও সমবাদী ছাড়া বাকি স্বরগুলো, যেগুলি রাগ প্রকাশে সহায়ক। |
১৩। | বিবাদীস্বর | যে স্বরের প্রয়োগ রাগের রূপ বিনষ্ট করে বা পরিবর্তন করে। |
১৪। | বর্জিতস্বর | যে স্বর রাগে সম্পূর্ণভাবে বর্জিত থাকে। |
১৫। | বক্রস্বর | আরোহন বা অবরোহনে সরল পথে না গিয়ে অন্য স্বর আশ্রিত হয়ে যাওয়া। আরোহনে উদাহরণ: মা, পা, ধা, না, ধা, সা → এখানে ‘নি’ বক্র। অবরোহনে উদাহরণ: পা, মা, গা, মা, রা, সা → এখানে ‘গা’ বক্র। |
১৬। | ন্যাসস্বর | যে স্বরে গান শেষ হয়। |
১৭। | সন্ন্যাসস্বর | যে স্বরে গানের প্রথম ভাগ শেষ হয়। |
১৮। | স্পর্শস্বর / কণস্বর | একটি স্বর বলার সময় অন্য একটি স্বরকে সামান্য ছুঁয়ে বললে শেষের স্বরকে স্পর্শস্বর বলা হয়। |
১৯। | পূর্বলগন কণ | মূল স্বর উচ্চারণের আগে অন্য স্বর স্পর্শ করা। |
২০। | অনুলগন কণ | মূল স্বরের শেষে অন্য স্বর স্পর্শ করা। |
২১। | আগন্তুকস্বর | শাস্ত্রীয় নিয়ম বহির্ভূত স্বর যা অবরোহনে কৌশলে রাগে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। |
২২। | অপন্যাসস্বর | গানের অংশের শুরুতে যে স্বর ব্যবহৃত হয়। |
২৩। | অংশস্বর / জীবস্বর | যে স্বর রাগে বারবার ব্যবহৃত হয়। একে রাগের প্রাণও বলা হয়। |
২৪। | আলঙ্কারিক স্বর | যেসব স্বর রাগে প্রাধান্য পায় না, বরং অন্য স্বরের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। |
২৫। | ইষ্টস্বর | যে মুহূর্তে যে স্বর প্রয়োগ উপযুক্ত মনে হয়। |
২৬। | গুপ্তস্বর | যেসব স্বরের প্রয়োগ অস্পষ্ট, কঠিন ও শিক্ষানির্ভর। |
২৭। | বৈদিকস্বর | বেদগানের সঙ্গে সম্পর্কিত মূল স্বর। |
২৮। | স্থানস্বর | উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত — এই তিন বৈদিক স্বরের নাম। এরা তিনটি স্থানের নির্দেশক। |
২৯। | লৌকিকস্বর | দেশীয় বা আর্যপূর্ব যুগে উদ্ভূত সাতটি স্বর। যেমন: সা, রা, গা, মা, পা, ধা, না। |
৩০। | তার | রাগে ব্যবহৃত সর্বোচ্চ স্বরের সীমা। |
৩১। | মন্ত্র | রাগে ব্যবহৃত সর্বনিম্ন স্বরের সীমা। |
🎼 রাগ ও রাগে বিভিন্ন ধরণের স্বরের ব্যবহার
১। সার্গামগীত বা স্বরমালিকা
সংজ্ঞা:
যেভাবে “কথা ও সুর” মিলিয়ে গান হয়, ঠিক তেমনি সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি ইত্যাদি স্বরের উচ্চারণ করেও গানের মতো পরিবেশনা করা যায়।
বিশেষত্ব:
- রাগের রূপ বজায় রেখে
- রাগে ব্যবহৃত স্বরগুলোকে তাল, মাত্রা ও লয়ে সাজিয়ে
- যে সঙ্গীত পরিবেশিত হয়, তাকে সার্গামগীত বা স্বরমালিকা বলা হয়।
২। লক্ষণগীত
সংজ্ঞা:
যে গানে কোনো রাগের ঠাট, জাতি, স্বর, বাদী-সমবাদী, পরিবেশনের সময় ইত্যাদি সব তথ্য থাকে এবং সেই রাগের রূপ বজায় রেখে গাওয়া হয়, তাকেই লক্ষণগীত বলা হয়।
উদ্দেশ্য: রাগ পরিচয় ও শিক্ষা।
৩। রাগ
সংজ্ঞা:
ঠাট থেকে উৎপন্ন হয়ে যে ধ্বনির সংযোজনে আরোহী-অবরোহী, আলাপ-বিস্তার, মীড়, মূর্ছনা, গমক, তান ইত্যাদি থাকে এবং তা শ্রোতার মনে আনন্দ সৃষ্টি করে, তাকে রাগ বলা হয়।
রাগের প্রকারভেদ:
- শুদ্ধ রাগ
- ছায়ালগ রাগ
- সংকীর্ণ রাগ
৪। শুদ্ধ রাগ
যে রাগ শাস্ত্রীয় নিয়ম অনুসারে যথাযথভাবে পরিবেশিত হয়, তাকে শুদ্ধ রাগ বলা হয়।
উদাহরণ: বিলাবল।
৫। ছায়ালগ রাগ
যে রাগ কোনো শুদ্ধ রাগের সামান্য ছায়া বা প্রভাব নিয়ে গঠিত হয়, তাকে ছায়ালগ রাগ বলা হয়।
উদাহরণ: ছায়ানট।
৬। সংকীর্ণ রাগ
যে রাগে শুদ্ধ ও ছায়ালগ রাগের মিশ্রণ থাকে, তাকে সংকীর্ণ রাগ বলা হয়।
উদাহরণ: পিলু।
৭। জনক রাগ বা আশ্রয় রাগ
হিন্দুস্থানি সংগীত পদ্ধতিতে সব রাগকে কোনো না কোনো ঠাটের অধীনে রাখা হয়।
যে রাগের নামের সঙ্গে ঠাটের নাম মিলে যায়, তাকেই আশ্রয় রাগ বা জনক রাগ বলা হয়।
উদাহরণ: ঠাট – বিলাবল, রাগ – বিলাবল।
৮। জন্য রাগ
আশ্রয় রাগ ব্যতীত যে সকল রাগ ঠাট থেকে উৎপন্ন হয়, তারা সবই জন্য রাগ।
৯। পকড়
রাগ চেনার জন্য যে বিশেষ কয়েকটি স্বরের ধারাবাহিক বিন্যাস ব্যবহার করা হয়, তাকেই পকড় বলে।
উদাহরণ (ইমন রাগ): না রে, গা রে সা, পা ক্ষ গা, রে সা।
১০। বিন্যাস
গানের প্রতিটি বিভাগের প্রথম চরণ যেই স্বরে শেষ হয়, তাকে বিন্যাস বলা হয়।
এই বিন্যাস রাগের আবহ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১১। অলংকার
স্বর সাধনার বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে অলংকার বলা হয়।
উপাদান: মীড়, গমক, আস – এগুলো গানের অলংকার হয়ে রাগের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
১২। মীড়
একটি স্বর থেকে ২–৩ বা তারও বেশি দূরের অন্য স্বরে অবিচ্ছিন্নভাবে গড়িয়ে যাওয়াকে মীড় বলে।
উদাহরণ: সা → মা
১৩। পুকার
স্বর সপ্তকের মধ্যে এক বা একাধিক স্বরের বিশেষভাবে পুনরুচ্চারণ (ধ্বনি-প্রকাশ) কে পুকার বলে।
উদাহরণ: সর্সা, ররা, গগা ইত্যাদি।
১৪। অঙ্গ
রাগে সপ্তকের স্বরগুলো বাদী স্বরের ভিত্তিতে দুই ভাগে বিভক্ত হয়। একে অঙ্গ বলে।
ক) পূর্বাঙ্গ
সপ্তকের সা থেকে মা পর্যন্ত (বা মতান্তরে পা পর্যন্ত) রাগের বাদী স্বর থাকলে সেটি পূর্বাঙ্গ রাগ।
উদাহরণ: রাগ ইমন – বাদী স্বর: গা।
খ) উত্তরাঙ্গ
পা থেকে সাʼ পর্যন্ত বাদী স্বর থাকলে সেটি উত্তরাঙ্গ রাগ।
উদাহরণ: রাগ বিলাবল – বাদী স্বর: ধা।
📌 ভাতখন্ডে জীর সময় নির্ধারণ অনুযায়ীঃ
- সকাল ১২টা পর্যন্ত গীত রাগসমূহ – পূর্বাঙ্গ রাগ প্রধান।
- রাত ১২টা পর্যন্ত গীত রাগসমূহ – উত্তরাঙ্গ রাগ প্রধান।
১৫। মূর্ছনা
সপ্তকের যে কোনো একটি স্বর থেকে শুরু করে ক্রমানুযায়ী অন্য স্বরের মাধ্যমে আরোহী বা অবরোহী বিন্যাসকে মূর্ছনা বলা হয়।
উদাহরণ:
- আরোহী: রে গা, মা পা, ধা না, সা
- অবরোহী: না ধা, পা মা, গা রে, সা
❖ তান ও তার প্রকারভেদ (Taan and Its Types):
ক্র. | তানের নাম | সংক্ষিপ্ত বর্ণনা | উদাহরণ |
১। | তান (Taan) | রাগে ব্যবহৃত স্বরসমূহের বিভিন্ন রচনাকে আকার সহযোগে দ্রুতগতিতে গাওয়াকে তান বলে। তান বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। | – |
২। | শুদ্ধ বা সরল/সপাট তান | রাগের আরোহী ও অবরোহী স্বরের ক্রমানুসারে গঠিত তান। | সরা, গপা, ধর্মা, বর্গা, বসা |
৩। | কূটতান | সরল নয়, বরং জটিল গতিতে গঠিত তান। | সপা, রমা, গপা, গরা |
→ আর্চিক | ১টি স্বরের তান | – | |
→ গাথিক | ২টি স্বরের তান | – | |
→ সামিক | ৩টি স্বরের তান | – | |
→ স্বরান্তক | ৪টি স্বরের তান | – | |
→ ঔড়ব | ৫টি স্বরের তান | – | |
→ ষাড়ব | ৬টি স্বরের তান | – | |
→ সম্পূর্ণ | ৭টি স্বরের তান | – | |
৪। | মিশ্রতান | শুদ্ধ ও কূটতানের সংমিশ্রণে গঠিত। | সরা, গপা, ধপা, গরা |
৫। | ছুটতান | দ্রুতগতিতে অবরোহীভাবে নামা। | গা-গরা, সনা, ধপা |
৬। | গমকতান | গমক সহযোগে গাওয়া তান। | সসা, মমা, রসা |
৭। | আলঙ্কারিক তান | অলংকারসদৃশ রচনাসহ গাওয়া তান। | সঞ্জমা, জমদা |
৮। | বক্রতান | বক্রভাবে গঠিত তান। | সগা, সমা, মধা |
৯। | ফিরততান | একই স্বর বিভিন্নভাবে প্রয়োগ। | গক্ষা গরা, গহ্মা গরা |
১০। | বোলতান | গানের কথা তানে উচ্চারিত হলে। | মগা-পক্ষা ধপা |
১১। | পালট/পাল্টা তান | আরোহী থেকে সরাসরি অবরোহী। | সর্না, ধপা, মগা |
১২। | হলক তান | জিহ্বার ভিতরে-বাইরে নড়াচড়ায় গঠিত। | – |
১৩। | খট্কা তান | থেমে থেমে বা ধাক্কা দিয়ে গাওয়া তান। | – |
১৪। | সরোক তান | চারটি স্বর একসঙ্গে উচ্চারণ। | সরগমা, রগমপা |
১৫। | অচরোক তান | একই স্বর দুইবার উচ্চারণ। | সসা, ররা, গগা |
১৬। | লড়ন্ত তান | সরল ও আড়ী লয় মিশ্রিত। | সরা, গগগগা |
১৭। | ঝটকা তান | প্রথম অংশে দুগুণ, শেষাংশে চৌগুণ লয়। | সরা, গমা, পধা, নিপা |
১৮। | গিটকিরি তান | দ্রুতলয়, ছোট, সরল তান। | – |
→ সাদা গিটকিরি | ক্রমান্বয়ে উঠে আবার ফিরে আসা। | সরগরা, রগমগা | |
→ সগম গিটকিরি | স্বর দু’বার উচ্চারণ + দূরবর্তী স্বর। | সসগগা, ররমমা |
নোট:
- কূটতানের সর্বোচ্চ সম্ভাব্য সংখ্যা একটি মূর্ছনায় হতে পারে ৫০৪০টি।
- ৫৬টি মূর্ছনায় কূটতান হয় ২৮,২০,২৪০টি।
- তাত্ত্বিকভাবে মোট ৪৮ কোটি তান সৃষ্টি সম্ভব।
🎵 বিভিন্ন প্রকার নাদ
“নাদ” শব্দটি দুটি ধাতু থেকে গঠিত—
- “ন” = প্রাণ (শ্বাস বা শক্তি)
- “দ” = অগ্নি (তাপ বা শক্তি)
অর্থাৎ, প্রাণ ও অগ্নির সংযোগে উৎপন্ন যে ধ্বনি, তাকেই নাদ বলা হয়।
নাদ প্রধানত দুই প্রকারে বিভক্ত:
১। নাদের শ্রেণিবিভাগ
নং | নাদের প্রকার | সংজ্ঞা | উপশ্রেণি/বিভাগ | উদাহরণ |
১ | আহত নাদ | যে নাদ বাহ্যিক আঘাতে স্থূলভাবে উৎপন্ন হয়, তাকে আহত নাদ বলে। | ১. বর্ণাত্মক ২. ধ্বন্যাত্মক |
গান, কবিতা পাঠ, তবলা, মৃদঙ্গের আওয়াজ |
২ | অনাহত নাদ | যে নাদ কোনো বাহ্যিক আঘাত ছাড়াই, আত্মিক বা আধ্যাত্মিকভাবে অভ্যন্তরীণভাবে অনুভব করা যায়, তাকে অনাহত নাদ বলে। | – | ধ্যান বা যোগের গভীর স্তরে অনুভূত নাদ |
২। আহত নাদের উপশ্রেণি
১) বর্ণাত্মক নাদ
- এটি কণ্ঠস্বর বা মৌখিক ধ্বনির মাধ্যমে উৎপন্ন হয়।
- যেমন: গান গাওয়া, কবিতা আবৃত্তি, বই পাঠ ইত্যাদি।
২) ধ্বন্যাত্মক নাদ
- এটি এক বস্তুর অন্য বস্তুর উপর আঘাত করার ফলে উৎপন্ন হয়।
- যেমন: তবলা, ঢোল, করতাল, ঝাঁঝর, পাথর বা কাঠের সংঘর্ষে উৎপন্ন শব্দ।
✨ বিশেষ মন্তব্য:
- আহত নাদের মধ্যেও সব শব্দ সঙ্গীতোপযোগী নয়।
- শুধুমাত্র সেই আহত নাদই সঙ্গীতে গ্রহণযোগ্য যেগুলোর ঝংকার, অনুরণন এবং শ্রোতার চিত্তে আনন্দ সঞ্চার করার ক্ষমতা রয়েছে।
🎼 বিভিন্ন প্রকার গমক
মধুরতা ও গাম্ভীর্যের সহিত কোনো স্বরকে বিশেষভাবে দুলিয়ে উচ্চারণ করার পদ্ধতি। আধুনিক কালে, এক স্বর থেকে অন্য স্বরে আরোহী বা অবরোহী গতিতে, নাভিমূল থেকে উদ্ভূত আন্দোলিত স্বরপ্রয়োগকেই গমক বলা হয়।
উদাহরণ: সা˷˷˷, রে˷˷˷, গা˷˷˷, মা˷˷˷ ইত্যাদি।
প্রাচীন মতে, গমকের ১৫ থেকে ২২ রকমের বিভাজন রয়েছে। নিচে গুরুত্বপূর্ণ ১৬টি গমকের তালিকা ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:
🗂 গমকের তালিকা (সারণি)
ক্র. | গমকের নাম | ব্যাখ্যা |
১। | স্ফুরিত গমক | দ্রুত গতির তৃতীয়াংশ সময়ের মধ্যে আন্দোলিত গমক; গিটকারী, মুরকী, জমজমা ইত্যাদির অন্তর্ভুক্ত। |
২। | কম্পিত গমক | দ্রুত অর্ধকাল সময়ে একই স্বরের কম্পন। বাদ্যযন্ত্রে এক আঘাতে দুই স্বরের দ্রুত প্রকাশ। |
৩। | চ্যাপিত গমক | স্বাভাবিক স্বর থেকে বিচ্যুত হয়ে নতুন স্বরের সৃষ্টি। |
৪। | আহত গমক | মূল স্বরের আগে বা পরে অন্য স্বরের মাধ্যমে ঝটকা দিয়ে মূল স্বর উচ্চারণ। |
৫। | আন্দোলিত গমক | দ্রুত স্বরকম্পনের পদ্ধতি। |
৬। | মুদ্রিত গমক | মুখ খুলে না গেয়েও গমক সৃষ্টি করা। |
৭। | প্লাবিত গমক | একটি স্বর থেকে অন্য স্বরে ঘর্ষণের মাধ্যমে যাওয়া; তারের বাদ্যে একে ‘সুত’ বা ‘ঘসীট’ বলা হয়। |
৮। | নামিত গমক | মন্দ্রস্থানে স্বরকম্পনের প্রয়োগ। |
৯। | গুস্মিত গমক | হৃদয় থেকে উদ্ভূত স্বরকম্পনের ধ্বনি। |
১০। | লীন গমক | আন্দোলিত গমকের মতো স্বরকম্পন। |
১১। | বলি গমক | স্বরগুলো বক্রভাবে ও দ্রুতভাবে প্রকাশ। |
১২। | কুরুল গমক | বলি গমকের মত দ্রুত স্বরকম্পনের প্রয়োগ। |
১৩। | ত্রিভিন্ন গমক | এক বা একাধিক স্বরকে তিনটি সপ্তকে দ্রুত সঞ্চালন। |
১৪। | তিরিপ গমক | দ্রুতের চতুর্থাংশ সময়ে স্বরকম্পন। |
১৫। | উল্লাসিত গমক | এক স্বর থেকে অন্য স্বরে আরোহনের সময় কম্পন প্রয়োগ। |
🎵 বিভিন্ন প্রকার আন্দোলন
আন্দোলন শব্দটির সাধারণ অর্থ হলো—দুটি বস্তুর পরস্পর সংঘর্ষের ফলে একটি বস্তু স্থানচ্যুত হয়ে এপাশ-ওপাশ দুলতে থাকে এবং এর ফলে বায়ুমণ্ডলে যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, তাকেই আন্দোলন বলা হয়। ধ্বনির জন্ম মূলত এই কম্পন বা আন্দোলনের মাধ্যমেই হয়।
যখন কোনো বাদ্যযন্ত্রের তারে আঘাত করা হয়, তখন তার কম্পন শুরু হয়—এবং সেই কম্পনের ফলে আমরা ধ্বনি শুনতে পাই।
- যদি আঘাত জোরালো হয়, তবে তারের ওঠানামা বা কম্পন বেশি হবে এবং ধ্বনিও জোরালো শোনা যাবে।
- আর যদি আঘাত দুর্বল হয়, তাহলে তারের আন্দোলনও কম হবে এবং ধ্বনি দুর্বল শোনা যাবে।
- কম্পন সম্পূর্ণ থেমে গেলে, ধ্বনিও আর শোনা যাবে না।
এক সেকেন্ডে আন্দোলনের সংখ্যা যত বেশি হবে, ধ্বনিও তত জোরে হবে।
📊 আন্দোলনের শ্রেণিবিন্যাস
নং | আন্দোলনের নাম | সংজ্ঞা |
১। | নিয়মিত আন্দোলন | যে আন্দোলনের গতিবেগ সমান থাকে, তাকে নিয়মিত আন্দোলন বলা হয়। |
২। | অনিয়মিত আন্দোলন | যে আন্দোলনের গতিবেগ অসমান বা অনিয়মিত হয়, তাকে অনিয়মিত আন্দোলন বলা হয়। |
৩। | স্থির আন্দোলন | যে আন্দোলন কিছু সময় স্থায়ী হয়, সাথে সাথে থেমে যায় না, তাকে স্থির আন্দোলন বলা হয়। |
৪। | অস্থির আন্দোলন | যে আন্দোলন খুব অল্প সময় স্থায়ী হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায়, তাকে অস্থির আন্দোলন বলা হয়। |
🎶 সঙ্গীতে বর্ণের পরিচয়
বর্ণ বলতে বোঝায়— গানের সেই সব ক্রিয়া বা প্রয়োগ, যার মাধ্যমে রাগের স্বরূপ প্রকাশিত হয়। সহজ কথায়, গানের গঠনে ব্যবহৃত প্রতিটি সুরের গতি ও প্রয়োগই “বর্ণ“ নামে পরিচিত।
বর্ণ চার প্রকারের হয়:
🔢 ১। বর্ণের প্রকারভেদ ও ব্যাখ্যা:
ক্র. | বর্ণের নাম | সংজ্ঞা / ব্যাখ্যা | উদাহরণ |
১। | স্থায়ী বর্ণ | একই সুর একাধিকবার উচ্চারিত বা বাদিত হলে তাকে স্থায়ী বর্ণ বলে। | সা সা সা, রা রা রা, গা গা গা |
২। | আরোহী বর্ণ | নীচের সুর থেকে উপরের দিকে সুর যাত্রা করলে তাকে আরোহী বর্ণ বলে। | সা রা গা মা পা ধা না |
৩। | অবরোহী বর্ণ | উঁচু সুর থেকে নিচের সুরে সুর যাত্রা করলে তাকে অবরোহী বর্ণ বলে। | না, ধা, পা, মা, গা, রা, সা |
৪। | সঞ্চারী বর্ণ | স্থায়ী, আরোহী ও অবরোহী বর্ণের সংমিশ্রণে গঠিত ক্রিয়াকে সঞ্চারী বর্ণ বলে। | সসা, রগা, পা, মগা, রগা, মপা, ধনা, সা |
📌 টীকা:
- স্থায়ী বর্ণ সাধারণত রাগের মূল আবেশকে ধরে রাখে।
- আরোহী ও অবরোহী বর্ণ রাগের গতিপথ নির্ধারণ করে।
- সঞ্চারী বর্ণ সঙ্গীতের রসে বৈচিত্র্য এনে দেয় এবং রাগকে পরিপূর্ণ করে তোলে।