রজনীকান্ত সেন : আসা যাওয়ার পথের ধারে কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের খেলা ঘরে মহাকালের বুক চিরে কালকে যাঁরা সীমার গণ্ডিতে ধরে রাখতে সাধনা করে গেছেন, মরণ সাগর পারে তাঁরা অমর। সেই কীর্তিমান প্রাত: স্মরণীদের জীবন জিজ্ঞাসা আমাদের চলমান জীবনে পারানির কড়ি স্বরূপ পাথেয় করে পান্থশালার দুদিন দিয়ে ঘেরা ঘরে আমি ছিলাম, আছি ও থাকব এই পরম সত্য ও চির জাগ্রত স্বত্ত্বার হাত ধরে প্রতিনিয়ত চক্রকার স্রোতে আমরা ভেসে চলেছি।
রজনীকান্ত সেন । শিল্পী জীবনী
যে মানুষটি মৃত্যুশয্যায় শুয়েও প্রচণ্ড শারীরিক যন্ত্রণাকে অগ্রাহ্য করে মৃত্যু দিন পর্যন্ত সঙ্গীতগত প্রাণ ছিল, যাঁর মধ্যে মানবাত্মার এক জ্যোতিস্ময় প্রকাশ দেখেছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ; তিনি রোগশয্যার পাশে বসে নিদারুন কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করতে দেখে পরে পরে সেই মানুষটিকে লিখেছিলেন……..
শরীর হার মানিয়াছে কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই, কণ্ঠ বিদীর্ণ হইয়াছে, কিন্তু সঙ্গীতকে নিবৃত্ত করিতে পারে নাই।”
এই প্রাতঃস্মরণীয় মহানমানবটি ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই পাবনা জেলার ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামে বিশেষ সরকারী পদে অধিষ্ঠিত এবং সঙ্গীতগুনী গুরুপ্রসাদ সেন মহাশয়ের ঘরে আবির্ভূত হন এবং জীবনাঙ্গনের খেলা শেষ করে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ৪৫ বৎসর বয়সে লীলাধাম পরিত্যাগ করেন। সেই মানুষটি অর্থাৎ কবি রজনীকান্ত সেন তাঁর স্বল্প পরিসর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিমগ্ন ছিলেন সঙ্গীত তথা সঙ্গীত সৃষ্টিতে।
কথা ও সুরের সহজ সারল্যে মাধুর্য্যে কান্তকবি রজনীকান্তের গান বাংলার এক অমূল্য সম্পদ। তিনি নিজের গানে নিজেই সুর দিতেন। যদিও সঙ্গীতে রজনীকান্তের কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, তাঁর ছিল অসাধারণ সঙ্গীত প্রতিভা যা ভগবদত্ত, ছোট থেকেই তাঁর সঙ্গীতে আগ্রহ, গান শুনতে ভালবাসতেন এবং শুনে গান আয়ত্ত করতে চেষ্টা করতেন।
রজনীকান্তের পিতা গুরুপ্রসাদ সেন প্রথমে ঢাকার মুন্সেফ এবং পরে বরিশালের সাবজজ হন। তিনি কবি ছিলেন, ব্রজবুলি ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলী ও শিবদুর্গা পদাবলী রচনা করে ও তাতে সুর সংযোজন করেছিলেন। রজনীকান্ত সেন তাঁর পিতার গুনের যোগ্য উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন, তিনি খুব ছোট বয়স থেকে গান বাঁধতে আরম্ভ করেছিলেন। পনের বছর বয়সে লেখা তাঁর দুটি গান “নবমী দুঃখের নিশি দুঃখ দিতে আইল” ও “মায়ের চরণ যুগল প্রফুল্ল কমল মহেশ স্ফটিক হলে”।
চৌদ্দ বছর বয়সে রজনীকান্ত এক সহচর লাভ করেছিলেন, তাঁর নাম তারকেশ্বর চক্রবর্তী, এক অর্থে এই তারেকশ্বর চক্রবর্তীই ছিলেন তাঁর সঙ্গীত গুরু, যদিও নিয়ম মেনে সঙ্গীতাভ্যাস রজনীকান্ত করেননি। আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রজনীকান্ত রাজসাহীতে ওকালতি ব্যবসা সুরু করেন। কিন্তু ওকালীতে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারেন নি। তাঁর নিজের লেখাতেই পাওয়া যায়,
“আমি আইন ব্যবসায়ী কিন্তু ব্যবসা করিতে পারি নাই আমি শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম, আমার চিত্ত তাই
লইয়াই জীবিত ছিল।”
কিশোর বয়সেই গান ছাড়াও কবিতা এবং নাট্যকলার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন ও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যানুরাগ আরও দৃঢ় হয়। তিনি নিজেও খুব ভালো গান গাইতেন এবং যে কোন সভা বা মজলিস বা অনুষ্ঠানে স্বরচিত গান গেয়ে আসর মাত করতেন। আর তাই মাননীয় প্রথমনাথ বিশী মহাশয় রজনীকান্তকে উৎসবরাজ আখ্যায় ভূষিত করেছেন।
১৯০২ সালে তাঁর প্রথম বই “বাণী” প্রকাশিত হয়। ১৯০৪ সালে কবির দ্বিতীয় গ্রন্থ “কল্যাণী” প্রকাশিত হয়, “কল্যাণী’তে কবি রাগ-রাগিনী ও তালের উল্লেখ করেছেন। “বাণীর প্রথম সংস্করণে রাগ ও তালের উল্লেখ ছিল না। তবে দ্বিতীয় সংস্করণে এগুলির উল্লেখও কিছু নতুন গান সংযোজন করা হয়। রজনীকান্তের সাহিত্য সৃষ্টির পরিমাণ খুব বেশি নয়। মৃত্যুর পূর্ব্বে তিনটি ও পরে পাঁচটি পুস্তক প্রকাশিত হয়।
রজনীকান্তের গানের ধারক ও বাহক ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী এবং রাজসাহীর কটা সাহেব বাঙ্গালী খ্রিস্টান হয়েও হিন্দু সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং আমৃত্যু তিনি রজনীকান্তের গুণগ্রাহী ছিলেন। রজনীকান্ত সেন তাঁর স্বল্প জীবনে ২৯০টি গান রচনা করেছেন। বাণীর সাথে সুরের একাত্মতা রজনীকান্তের গানকে এক অপূর্ব মহিমায় আসীন করেছে। রজনীকান্তের গানগুলিকে মূলত চার ভাগে ভাগ করা যায় যথা ভক্তিমূলক গান, দেশাত্মবোধক গান, হাস্যরসাত্মক গান এবং জীবনের গান।
নির্দ্বিধায় বলা যায় যে ভক্তিমূলক গানগুলিই রজনীকান্তের সর্ব্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি। এ জাতীয় গানে তাঁর প্রতিভার চরম বিকাশ, বৈষ্ণব, শাক্ত পদকর্তাগণ বাউল ও অন্যান্য সহজিয়া সঙ্গীত স্রষ্টা পরে রামমোহন, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, নজরুল প্রমুখ কবি ও সঙ্গীতকারেরা বিভিন্ন সময়ে বাংলার ভক্তিগীতের ধারাটিকে পুষ্ট করেছেন। রজনীকান্তের ভক্তিগীতিগুলিও এই প্রবাহের অন্তর্গত, তাঁর মধ্যে যে ঐকান্তিক ঈশ্বর নির্ভরতা ছিল তা তাঁর ভক্তিগীতির মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর “বাণী” এবং “কল্যাণী” মুখ্যতঃ ভক্তিগীতের সংকলন।
দেশাত্মবোধক ও হাসির গান উক্ত পুস্তক দুটির মধ্যে স্থান পেয়েছে ভক্তিসঙ্গীতগুলির ফাঁকে ফাঁকে। তাঁর ভক্তিভাবাত্মক গানের বহু দৃষ্টান্তের কয়েকটি দেওয়া হল । “তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে”, “আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে”, “পাতকী বলিয়ে কি গো পায়ে ঠেলা ভাল হয়” ইত্যাদি। কবির জীবনে চলতি পথে মাঝে মাঝেই আত্মীয় বিয়োগ জনিত শোকের ছায়াপাত ঘটেছে। কিন্তু ঈশ্বর বিশ্বাসের জোরে তিনি এসব শোক সহ্য করেছেন এবং রচনা করেছেন অপূর্ব সব সঙ্গীত। তাঁর তৃতীয় পুত্রের মৃত্যুতে নিদারুণ শোক পেয়েছিলেন, আর “তোমারি নেওয়া প্রাণে, তোমারি দেওয়া দুঃখ, তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব,” গানটি রচনা করে এবং গেয়ে সান্তনা লাভ করেছিলেন।
রোগশয্যায় রবীন্দ্রনাথ তাঁকে একবার দেখতে গিয়েছিলেন, তাঁর চলে যাবার পর কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ রজনীকান্ত সেন একটি গান রচনা করে পাঠিয়েছিলেন “আমায়, সকল রকম কাঙাল করেছে গর্ব করিতে চুর, যশ ও অর্থ, তাই মান ও স্বাস্থ্য সকলি করেছে দূর।”
ওর প্রতিটি ছত্রে যেন ঈশ্বরের প্রতি সর্ব্বসমর্পণের আকুতি ঝরে পড়েছে। তাই প্রথমনাথ বেশী মহাশয় বলেছেন, “কান্ত কবির ভক্তিসঙ্গীতগুলি বাংলা ভক্তি পদাবলীর জাহ্নবীতে যে একটি চিরসলিলা উপনদীরূপে যুক্ত হইয়া আমাদের মানসিক সম্পদকে চিরদিনের জন্য বাড়াইয়া নিয়াছে তাহা অবিনশ্বর।”
রজনীকান্তের লেখা দেশাত্মবোধক গানগুলি, তখনকার দিনে সর্বসাধারণের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, বিশেষ করে তাঁর লেখা ও গাওয়া “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই: দিন দুখিনী মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই,” গানটি প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং লোকের মুখে মুখে ফেরে, তাঁর কয়েকটি দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের মধ্যে “জাগ সুমঙ্গলময়ী মা মুখরি তরু পিক গাহি, করুক প্রচারিত মহিমা।” “জয় জয় জনমভূমি, জননী” “তব চরণ নিম্নে উৎসবময়ী শ্যাম ধরণী সরসা,” “নমো নমো নমো জননী বঙ্গ” প্রভৃতি।
হাস্যরসাত্মক গান রজনীকান্তের সঙ্গীতের আর একটি দিক। তিনি সাধারণত: হাসির গানগুলি হাসির সঙ্গে করুণ তথা শান্ত রস মিশ্রিত করে রচনা করতেন, যার জন্য দ্বিজেন্দ্রলালের অনুসারী হয়েও দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানের সঙ্গে তার গানের প্রভেদ ছিল। প্রমথনাথ বিশী মহাশয় কান্তকবির হাস্যরসাত্মক গানের যে মন্তব্য করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য, “দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান যদি শুষ্ক শীতের বাতাস হয় তবে রজনীকান্তর হাসির গান বর্ষার জলভারাক্রান্ত পুরো বাতাস।”
রজনীকান্ত নিজের হাস্যরস সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন “যে হাস্যরসের মধ্যে অন্তঃসলিলা ফল্গুর ন্যায় অসমান্য গভীর ভাবের স্রোত প্রবাহিত হয়, তাহাই উৎকৃষ্ট হাস্যরস। হাস্যরস যদি প্রচ্ছন্ন ভাবে উপদেশ মূলক হয়, তাহা হইলে হাস্যরস ইহজগতে কখনই সম্পূর্ণ অনাবশ্যক নয়।” তাঁর হাসির গান তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথা-উপদেশ মিশ্রিত হাসির গান, সমাজ সম্পৰ্কীয় হাসির গান ও বিশুদ্ধ উপভোগের জন্য হাসির গান। তাঁর একটি উপদেশমূলক হাসির গান, সাধনার ধন। ব্যাঙ্গাত্মক গান-“ যে পথে ঘাটে দেখতে পাবে?” তাঁর আরও কয়েকটি হাসির গান-
“সে, কি রে মন, মুড়কী মুড়ী, মতা জিলাপী কচুরি?
যে তাম্রখণ্ডে খরিদ হয়ে উদরস্ত হয়ে যাবে?”
“আমরা ব্রাহ্মণ বলে নোয়াব না মাথা কে আছে এমন হিন্দু?” এবং ডাক্তার শীর্ষক গানে একস্থানে বলেছেন Medical certificate এর জন্য এলে ধনী কেহ, ঐ, জলপানি কিঞ্চিৎ হাতিয়ে, বলে দেই, ‘অভি রুগনে দেহ’ ইত্যাদি।
আধুনিক সাহিত্যে প্রেম একটি প্রধান স্থান দখল করলেও রজনীকান্তের প্রেমের গান বিশেষ দেখা যায় না। তবে একেবারে বিরল নয়, যথা- “মধুর সে মুখখানি কখনও কি ভোলা যায়, স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি, রেখেছি স্বপনে ঢাকিয়া।” রজনীকান্তের গানের সুর প্রধানত: সহজ সরল, জটিলতা বা সুরের মার প্যাঁচ বিশেষ নেই, অথচ গানগুলি প্রচণ্ড হৃদয়গ্রাহী এবং সহজেই গানের মধ্যে প্রবেশ করা যায়, তাঁর বহু গানই রাগাশ্রিত কিন্তু কখনই তা রাগ প্রকাশের বাহন হয়নি।
রাগমিশ্রিত অসংখ্য গানের মধ্যে কয়েকটি রাগেশ্রীতে “অনন্ত দিগন্ত ব্যাপী অনন্ত মহিমা তব, ” মালকোষ-“অসীম রহস্যময়। হে অগম্য। হে নির্বেদ।” পরজ-এ “তব বিপুল প্রেমাচল চুড়ে”, ভৈরবীতে- “তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে,” বেহাগ-এ “আমি অকৃতি বলেও তো, কিছু” বারোয়াতে “ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়,” গৌরীতে- “সেখা আমি কি গাহিব গান,” বসন্ত-বাহার এ-“মাগো আমার সকলি ভ্রান্তি, ” সুরট মল্লার- এ-“নমো নমো নমো জননী বঙ্গ, ইত্যাদি।
এছাড়া আরো অনেক রাগে অনেক গান আছে, দেশজ সুরেরও প্রভাব দেখা যায় তাঁর গানে। যেমন: বাউলের সুরে- “কুলু কুলু কুলু নদীর বয়ে যায়,” “প্রেমে ভাল হয়ে যাও গলে,” “তুমি আমার অন্তঃস্থলের খবর জান” ইত্যাদি, কীর্তনের সুরে, “নাথ ধর হাত,” – মনোহরসাই ঢঙ্গে – “যেমনটি তুমি দিয়েছিলে মোরে” “ক্ষুদ্র হৃদয় পথল জল ইত্যাদি। রামপ্রসাদী সুরে “আমায় পাগল করবি কবে” “মা আমি যেমন তোর মন্দ ছেলে, “মা কখন এলে, কখন গেলে,” প্রভৃতি।
অন্যান্য সুরের অনুসারী তিনি কয়েকটি গান রচনা করেছেন, তবে তিনি তা অকপটে স্বীকার করে গেছেন। তাঁর গানে পাশ্চত্য সঙ্গীতের প্রভাব প্রায় নেই বললেই চলে, তবে ব্যান্ডের ছন্দে একটি স্বদেশী গান রচনা করেছেন, “ফুলার কল্পে হুকুমজারী। ”
একতাল, তেওরা, কাওয়ালী, গড়খেমটা, ঝাঁপতাল, আড়খেমটা, যত্, কাহরবা প্রভৃতি তাল রজনীকান্ত ব্যবহার করেছেন তাঁর বিভিন্ন গানে। রজনীকান্তের অনেক গান রেকর্ড হয়েছে, কিন্তু তার বহু আগে তিনি নিজেও একবার তাঁর গান রেকর্ড করেছিলেন। এছাড়া অন্যান্য বহু নামী শিল্পী তাঁর গান প্রচার ও প্রসারে একনিষ্ঠ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই কালোত্তীর্ণ শিল্পী তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমাদের তথা উত্তরসুরী প্রজন্মের মধ্যে যে শ্রদ্ধার আসন পেতে গেছেন তা চিরকাল অম্লান থাকবে।