দ্বিজেন্দ্রলাল রায় । শিল্পী জীবনী

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ১৯ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কার্তিকেয় রায় ছিলেন কৃষ্ণনগর মহারাজার দেওয়ান এবং স্থানীয় সম্রান্তদের মধ্যে বিশেষ একজন। কিন্তু কার্তিকেয় রায় সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বললেই তাঁকে সম্পূর্ণ চেনা বা জানা যায় না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার, রসিক, দেশাহিতৈষী, মানবদরদী এবং স্বজনবৎসল। সাহিত্য, সঙ্গীত এবং নানাবিধ শিল্পকলার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল অপরিসীম।

 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় । শিল্পী জীবনী

তৎকালীন বাঙ্গালী বিদগ্ধজনের মধ্যে বোধহয় কেউ তাঁর সান্নিধ্যে না এসে পারেন নি। তাঁর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই তাঁকে সৰ্ব্বজনশ্রদ্ধেয় করে তুলেছিল। কার্তিকেয়র এ-সকল মহৎগুণ তাঁর পুত্রদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। শৈশবেই তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। ছোটবেলা থেকেই গান, আবৃত্তি এবং কবিতা লেখার প্রতি তাঁর অনুরাগের পরিচয় মেলে।

প্রায় ১২ বৎসর বয়সেই তাঁর কবিতা লেখার হাতে খড়ি হয়। ছোট বয়সেই দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর বাড়ীতে উপস্থিত বিদ্যাসগার, অক্ষয়কুমার দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, সঞ্জীবচন্দ্র, বঙ্গিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিদগ্ধজনের সামনে আবৃত্তি করে বিশেষ প্রশংসা অর্জন করেন।

 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

 

অল্প বয়সেই (২১.২২ বৎসর) এম.এ পাশ করে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে উন্নততর কৃষিবিদ্যা শিক্ষালাভের জন্য বিলেত যান। প্রবাসে থাকাকালীন সঙ্গীত তথা সাহিত্যচর্চায় তাঁর এতটুকু ভাটা পড়ে নি। পাশ্চাত্য সঙ্গীত এবং ললিতকলার প্রতি তিনি বিশেষ আসক্ত হন এবং বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় পুস্তক রচনার করেন। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা সমাপনান্তে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। সেই সময় থেকেই তাঁর কর্মজীবনের সুরু। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের জৌষ্ঠ কন্যা সুরবালার পাণীগ্রহন করেন।

কালের অঙ্গনে এমন কিছু লোক আমাদের চলমান জীবনে আবির্ভূত হন যাদের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে শ্রষ্টার অকৃত্রিম প্রতিভার সাক্ষ্য মেলে। কবি, গায়ক, নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল সেই মানুষদেরই প্রথম সারির একজন। দেশপ্রেমিক, দেশহিতৈষী দ্বিজেন্দ্রলাল তৎকালীণ নব্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাবুদের ইংরেজী শিক্ষার শিক্ষিত নকলনবিশী এবং সামাজিক ত্রুটি-বিচ্যুতিকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত ব্যাঙ্গাত্মক হাসির গান সৃষ্টি করে গেছেন তা অভিনব।

 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

 

তিনি পৌরাণিক, ঐতিহাকি নাটকের পটভূমিকায় এবং দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে দিয়ে পরাধীন ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহা জাগিয়ে তুলেছিলেন। এই স্বল্প পরিসরে দ্বিজেন্দলাল রায়ের মতন মহান জীবনচিত্র ও দর্শন ফুটিয়ে তোলা এক প্রকার অসম্ভব।

বিধির নিষ্ঠুর পরিহাস এই যে, তাঁর বিবাহিত জীবনের সুমধুর দিনগুলি বহুদুর প্রসারিত হওয়ার আগেই তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিনী ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দে ২৯ শে নভেম্বর পরলোক গমন করেন। ফলে তিনি ভগ্ন হৃদয়ে এবং ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে জীবনের বাকী দিনগুলি অত্যন্ত একাকীত্বের মধ্যে কাটান।

কবির সৃষ্ট গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘আর্যগাঁথা-১ম খণ্ড (১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ), ‘আর্যগাঁথা- ২য় খণ্ড (১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ), ‘দ্যা লিরিক্স অব ইন্ড’ (১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ), ‘আষাঢ়’ (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ), ‘হাসির গান’ (১৯০০ খ্রিস্টাব্দ), ‘মন্ত্র’ (১৯০২ খ্রিস্টাব্দ), ‘আলেখ্য’ (১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ), ‘ত্রিবেণী’ (১৯১২ খ্রিস্টাব্দ), ইত্রাদি গ্রন্থ এবং ‘সাজাহান’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘নুরজাহান’, ‘মেবারপতন,’ ‘দূর্গাদাস’, ‘সীতা’ প্রভৃতি নাট্যগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রখ্যাত নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর জীবনমঞ্চের নাট্য সমাধা করে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মে ইহলোক পরিত্যাগ করে প্রার্থিত দুনিয়ার অন্বেষণে পাড়ি দেন।

Leave a Comment