ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হাজার বছরের এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। এই ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে “রাগ”। রাগ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত “রঞ্জ” ধাতু থেকে—যার অর্থ মনকে রঞ্জিত করা বা মোহিত করা। অতএব, রাগ কেবল ধ্বনির বিন্যাস নয়, এটি এমন এক সৌন্দর্যশাস্ত্র যা শ্রোতার মনে এক গভীর ও সৌম্য অনুভূতির জাগরণ ঘটায়। এটি একাধারে গাণিতিক সংগঠনের শৃঙ্খলা এবং আবেগপ্রবণ আত্মিক সাধনার সেতুবন্ধন।
সঙ্গীতজ্ঞ ও রসানুরাগীদের কাছে রাগ শুধু একটি সুরের কাঠামো নয়, বরং এটি এক পরিপূর্ণ রসাত্মক জগৎ, যেখানে প্রতিটি স্বর, প্রত্যেক চাল, প্রতিটি স্পর্শ এমনকি নীরবতাও একটি অর্থ বহন করে। এই আলোচনায় আমরা রাগের সংজ্ঞা, গঠন, শ্রেণীবিন্যাস এবং বৈশিষ্ট্যগুলি বিস্তারিতভাবে অনুধাবন করব।
রাগের সংগা ও বৈশিষ্ট্য
🧭 রাগের সংজ্ঞা: শাস্ত্রীয় দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা
শ্রুতিনির্ভর ভারতীয় সঙ্গীতে রাগের কোনো একক ও নির্ধারিত সংজ্ঞা নেই। বরং যুগে যুগে সঙ্গীতাচার্যরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাগকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
🎓 প্রাচীন সংজ্ঞা
প্রাচীন গ্রন্থ ‘সঙ্গীতরত্নাকর’-এ বলা হয়েছে:
“রঞ্জয়তি শ্রোতাম্ ইতি রাগঃ।”
অর্থাৎ, যা শ্রোতার মনকে রঞ্জিত করে, আনন্দ দেয়, তাকেই রাগ বলে।
এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, রাগ হলো এমন এক ধ্বনিসমষ্টি যা নির্দিষ্ট গঠনের মধ্য দিয়ে শ্রোতার মনে অনুভূতির সৃষ্টি করে। শুধু স্বর থাকলেই রাগ হয় না, বরং স্বরগুলোর নিখুঁত বিন্যাস, সময়চেতনা, রস, এবং চরিত্র থাকতে হয়।
🎼 আধুনিক সংজ্ঞা
আধুনিক সংগীতশাস্ত্র মতে,
“রাগ হলো একটি সংগীতিক কাঠামো, যা স্বরের নির্বাচন ও বিন্যাসের মাধ্যমে আরোহ, অবরোহ, বাদী, সমবাদী, সময় ও রসের একটি সমন্বিত রূপ উপস্থাপন করে।”
অর্থাৎ রাগ হলো এক সাংগীতিক জীবন্ত রূপ, যার নিজস্ব গতি, ছন্দ, আবেগ, এবং সৌন্দর্য রয়েছে। এই কাঠামোর প্রতিটি উপাদান একটি রাগকে স্বতন্ত্র করে তোলে।
🎵 রাগের গঠন ও মূল উপাদানসমূহ
একটি রাগ গঠনের জন্য কিছু নির্দিষ্ট উপাদান বা মূল বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক। এগুলো ছাড়া কোনো স্বরসমষ্টি রাগ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
রাগের মূল উপাদান:
- আরোহ (Ascending Scale) – রাগের স্বরসমূহ যেভাবে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে।
- অবরোহ (Descending Scale) – রাগের স্বরসমূহ যেভাবে নিচের দিকে নামে।
- বাদী স্বর – যে স্বর রাগে প্রধানতম ও প্রাধান্যপ্রাপ্ত, যা রাগের প্রাণ।
- সমবাদী স্বর – বাদী স্বরের সঙ্গে সবচেয়ে সুন্দর সঙ্গতিপূর্ণ স্বর।
- বর্জ্য স্বর – কোনো কোনো রাগে কিছু স্বর ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়।
- আলঙ্কার ও চাল – বিশেষ ধরনের সুরসজ্জা বা অলঙ্কার ব্যবহার।
- রাগের সময় – রাগ পরিবেশনের নির্দিষ্ট সময় (প্রহরভেদে)।
🧬 রাগের শ্রেণীবিন্যাস: জাতি অনুসারে
রাগের শ্রেণীবিন্যাস মূলত স্বরের সংখ্যার ভিত্তিতে তিনটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এগুলোকে রাগের জাতি বলা হয়।
| 🌿 জাতির নাম | 🪕 ব্যাখ্যা | 🎶 স্বরের সংখ্যা |
| সম্পূর্ণ জাতি | সব সাতটি স্বর ব্যবহৃত হয় | ৭ |
| ষাড়ব (খাড়ব) জাতি | একটি স্বর বাদ থাকে | ৬ |
| ঔড়ব জাতি | দুটি স্বর বাদ থাকে | ৫ |
এখানে লক্ষ্যণীয়, অনেক রাগে আরোহীতে এক রকম স্বর এবং অবরোহীতে ভিন্ন রকম স্বর ব্যবহার করা হয়, ফলে একই রাগে দুটি জাতির মিশ্রণও পাওয়া যায় (যেমন: ঔড়ব-ষাড়ব জাতি)।
🏛️ রাগের উৎপত্তি: ঠাট ও তত্ত্ব
রাগের ভিত্তি গঠিত হয় ঠাট নামে পরিচিত সাপেক্ষ কাঠামো থেকে। উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতে মূলত দশটি ঠাট প্রচলিত, যেগুলো হলো:
- বিলাবল
- খাম্বাজ
- কাল্যাণ
- ভৈরব
- আসাওয়ারি
- ভৈরবী
- পুরবী
- মারওয়া
- তোড়ী
- কাফি
প্রতিটি ঠাট নিজস্ব স্বরসংস্থান এবং আবহ নিয়ে উপস্থিত হয় এবং তার থেকে বিভিন্ন রাগের জন্ম হয়। বলা হয়, “ঠাট হলো বৃক্ষ এবং রাগ হলো তার ডালপালা ও পুষ্প”।
✨ রাগের বৈশিষ্ট্যসমূহ (১০টি মূল লক্ষণ)
প্রাচীন ও আধুনিক শাস্ত্র অনুসারে নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো একটি রাগকে সত্যিকার অর্থে ‘রাগ’ করে তোলে:
- স্বরসমূহের একটি নির্দিষ্ট ও রসাত্মক বিন্যাস থাকবে।
- মনোরঞ্জন করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
- একই রাগে সাধারণত এক স্বরের দুই রূপ (যেমন কোমল ও তীব্র বা শুদ্ধ ও কোমল) পাশাপাশি থাকবে না।
- কমপক্ষে পাঁচটি স্বরের ব্যবহার আবশ্যক।
- মধ্যম (মা) ও পঞ্চম (পা) উভয় স্বর একই রাগে একসঙ্গে বাদ দেওয়া যাবে না।
- ষড়জ (সা) কোনো রাগেই বাদ দেওয়া যাবে না।
- রাগের উৎপত্তিস্থল হিসেবে ১০টি ঠাট মেনে চলা হয়।
- আরোহী, অবরোহী, বাদী, সমবাদী ইত্যাদি নির্দেশ থাকা বাধ্যতামূলক।
- বাদী ও সমবাদী স্বরের মধ্যে অন্তত ৭ শ্রুতি ব্যবধান থাকতে হবে।
- রাগের জাতি (ঔড়ব, খাড়ব, সম্পূর্ণ) সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত থাকবে।
🪔 রাগ: অনুভূতির রসায়ন
রাগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার ভাব বা রস। প্রতিটি রাগের নিজস্ব এক চরিত্র, আবেগ ও সময় থাকে। যেমন—
- রাগ ভৈরব – প্রভাতের পবিত্রতা ও গাম্ভীর্য প্রকাশ করে
- রাগ যামন – সন্ধ্যার কোমলতা ও রোমান্সের মাধুর্য বহন করে
- রাগ মারওয়া – গোধূলি লগ্নের অস্থিরতা ও রহস্যময়তা তুলে ধরে
- রাগ ভূপালি – সরলতা, শান্তি ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক
রাগ কেবল শুনে বোঝা যায় না—এটিকে উপলব্ধি করতে হয়, ধ্যান করতে হয়, সাধনা করতে হয়।
🎤রাগসাধনার অন্তর যাত্রা
রাগ শুধুমাত্র একটি সংগীত কাঠামো নয়—এটি এক গভীর আত্মসাধনা। একজন রাগসাধকের কাছে প্রতিটি রাগ একটি জীবন্ত চরিত্রের মতো, যার আবেগ, কণ্ঠস্বর, ও প্রকাশভঙ্গি আছে।
এই সাধনা কেবল কণ্ঠ বা বাদ্যযন্ত্রের অনুশীলনে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা মনের প্রশান্তি, অনুভূতির পরিশীলন ও শ্রোতার আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের একটি মাধ্যম।
রাগকে বুঝতে হলে তাকে অনুভব করতে হয়, শুনতে হয়, চর্চা করতে হয়, এবং ধীরে ধীরে আত্মস্থ করতে হয়। এক্ষেত্রে ধৈর্য, নিষ্ঠা এবং গুরুপরম্পরার ভূমিকা অপরিসীম।
আরও দেখুন: