দশটি ঠাঁট থেকে উৎপন্ন রাগসমূহ

সঙ্গীতশাস্ত্রে ‘ঠাঁট’ ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে, যা মূলত নির্দিষ্ট মেলোডিক ফ্রেম বা স্কেলকে বোঝায়। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে প্রধানত দশটি মূল ঠাঁট রয়েছে, যেগুলি থেকে অসংখ্য রাগের উৎপত্তি ঘটে। প্রতিটি ঠাঁটের নিজস্ব সুরবিন্যাস, স্বরসংযোগ এবং রাগচর্চার দিক থেকে একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য থাকে। ঠাঁটের মাধ্যমে রাগের মূড, ভঙ্গিমা এবং আবেগ প্রকাশের বিশেষ ক্ষমতা পাওয়া যায়, যা শ্রোতাদের হৃদয়ে বিশেষ এক অনুভূতি জাগ্রত করে।

এই দশটি ঠাঁটের বিশ্লেষণ ও তার থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন রাগের বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান করলে আমরা ভারতীয় সঙ্গীতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও জটিল সুরসৃষ্টির অন্তর্নিহিত কাঠামোকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারব। তদ্বারা শুধু সংগীতজ্ঞরাই নয়, সাধারণ শ্রোতাও রাগ ও ঠাঁটের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের সঙ্গীতীয় প্রভাব সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি অর্জন করতে সক্ষম হবেন।

এই প্রবন্ধে আমরা মূল দশটি ঠাঁটের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, তাদের সুররূপ এবং সেই দশটি ঠাঁট থেকে উৎপন্ন প্রধান রাগগুলোর বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব। এছাড়া, রাগগুলোর প্রয়োগ ও বর্তমান আধুনিক সঙ্গীতে তাদের স্থান নিয়েও সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা হবে।

দশটি ঠাটের গঠন:

ঠাটের নাম গঠন (স্বরসমূহ)
১. বিলাবল ঠাট স, র, গ, ম, প, ধ, ন
২. কল্যাণ ঠাট স, র, গ, ম, প, ধ, ন (প্রধানত শুদ্ধ স্বর, বিশেষ করে মাধ্যম ও ধাতুর স্বরে)
৩. খাম্বাজ ঠাট স, র, গ, ম, প, ধ, ন (শুদ্ধ মাধ্যম ও ধাতু, কিন্তু বিভিন্ন ভেদ থাকে)
৪. কাফি ঠাট স, র, গ, ম, প, ধ, ন (প্রধানত কমল মাধ্যম এবং ধাতুর ব্যবহার)
৫. আসাবরী ঠাট স, র, গ, ম, প, ধ, ন (মন্দ্র স্বরের প্রাধান্য, বিশেষত কমল গাঁধার ও ধাতুর ব্যবহার)
৬. মারবা ঠাট স, র, গ, ম, প, ধ, ন (শুদ্ধ মাধ্যম ও ধাতু থাকে)
৭. ভৈরব ঠাট স, র, গ, ম, প, ধ, ন (প্রধানত শুদ্ধ মাধ্যম ও ধাতু)
৮. ভৈরবী ঠাট স, র, গ, ম, প, ধ, ন (মন্দ্র গাঁধার ও কমল ধাতু ব্যবহার হয়)
৯. পূরবী ঠাট স, র, গ, ম, প, ধ, ন (মাধ্যম ও ধাতু ভেদে পরিবর্তিত)
১০. টোড়ী ঠাট স, র, গ, ম, প, ধ, ন (শুদ্ধ ও কমল মাধ্যম ব্যবহৃত হয়)

দ্রষ্টব্য:

  • এখানে ‘স’ = ষড়জ (শদ্জ), ‘র’ = রিষভ, ‘গ’ = গন্ধার, ‘ম’ = মাধ্যম, ‘প’ = পান্ডব, ‘ধ’ = ধৈব, ‘ন’ = নিসাদ।
  • প্রতিটি ঠাটে ৭টি স্বরের উপস্থিতি থাকে, তবে কিছু ঠাটে মাধ্যম বা ধৈব স্বরের শুদ্ধ/কমল বা অন্য রূপ ভিন্ন হতে পারে।
  • ঠাটের মূল স্বর সমূহ ১২টি স্বরের মধ্যে থেকে ৭টি নির্ধারিত নিয়মে ক্রমবদ্ধ থাকে।

 দশটি ঠাঁট থেকে উৎপন্ন রাগসমূহ

 

 দশটি ঠাঁট থেকে উৎপন্ন রাগসমূহ

 

দশটি ঠাট থেকে উৎপন্ন রাগসমূহ:

ঠাটের নাম ঠাট থেকে উৎপন্ন রাগসমূহ
. বিলাবল ঠাট বিলাবল, বিহাগ, বিহাগড়া, দেশকার, পাহাড়ী, কুকুভ, শঙ্করা, নট্, মাঁড়/মান্ড, সরপর্দা, আলাইয়া/আলাহিয়া বিলাবল, গুণকেলী, শুরু বিলাবল, নট বিলাবল, হংস-ধ্বনি, লচ্ছাশাখ, হেম, দূর্গা, নওরৌচকা, মলুহা, পটমঞ্জুরী, দেবগিরি, পটবেহাগ, জলধর, কেদার, ইমনি বিলাবল, কর্ণাট, কেদারনট, ছায়া, ছায়ানট, জয়জয়বিলাবল, হেমকল্যাণ, শঙ্করাভরণ, নট নারায়ণী, নট মল্লার, বঙ্গাল বিলাবল, ভবশাখ, ভিন্নষড়জ, মল্লার, মাঢ়, লচ্ছাসার, লুম, নাগস্বরাবলী, বিভাস, দীপক ইত্যাদি।
. কল্যাণ ঠাট ইমন, শুদ্ধ কল্যাণ, ইমন কল্যাণ, কল্যাণ, শরৎ, ধবলাশ্রী, ভূপালী, হাম্বীর, কেদারা, ছায়ানট, কামোদ, শ্যামকল্যাণ, হিন্দোল, গৌড় সারং, মালশ্রী, ইমনি বিলাবল, চন্দ্রকান্ত, সারনী কল্যাণ, জেত কল্যাণ, পুরিয়া কল্যাণ, জলধর কেদারা ইত্যাদি।
. খাম্বাজ ঠাট খাম্বাজ, ঝিঝিঁট, সৌরট, দেশ, খাম্বাবতী, তিলং, রাগেশ্রী, জয়জয়ন্তী, গৌড় মল্লার, নটমল্লার, তিলককামোদ, বড়হংস, গারা, নারায়ণী, প্রতাপবরালী, নাগস্বরাবলী, অরুণ মল্লার, খোকর, জাজমল্লার, ধুরিয়ামল্লার, পাহাড়ী, বিহগড়া, মাঢ়, মেঘ, মেঘমল্লার, সুরদাসী মল্লার, সুরট, শুদ্ধমল্লার ইত্যাদি।
. কাফি ঠাট কাফি, ধানেশ্রী, সিন্ধুড়া, ধানী, ভীমপলশ্রী, বিহারী, মধুমাদ বাগেশ্রী, হোসেনী, কানাড়া, মেঘমল্লার, রামদাসী মল্লার, মিঞা কি মল্লার, সুহা, নীলম্বরী, সুর মল্লার, পটদীপ, সাহানা, দেবশাখ, হংসকঙ্কনী, বৃন্দাবনী সারং, পিলু, কৌশী কানাড়া, নায়কী কানাড়া, মিঞা কি সারং, সুঘরাই, শুদ্ধ সারং, বাড়োয়া, সামন্ত সারং, শ্রীরঞ্জনী, লঙ্কাদহন, অঞ্জলী টৌড়ী, কাফি-কানাড়া, কোহল-কানাড়া, গরো কানাড়া, গৌড় মল্লার, চন্দ্রকোষ, জিলহা, দেশ, ধানী, নাগধ্বনি কানাড়া, নাট, পটমঞ্জরী, পটদীপকী, পলাসী, বাহার, ভীম, মধু মাধবী সারং, মাঝ, মালগুঞ্জ, মীরামল্লার, মীরা সারং, মুখারী ইত্যাদি।
. আসাবরী ঠাট আসাবরী, জৌনপুরী, দেবগান্ধার, সিন্ধু, আড়ানা, কৌশী, দরবারী, দেশী, খট, আভোগী, আভীগী, কাফি-টোড়ী, গান্ধারী, গোপীবসন্ত, দরবারী-কানাড়া, দেশী টোড়ী, নায়কী কানাড়া, পিলু, মীরা বাঈ কি মল্লার, সিন্ধু ভৈরবী, জংলা, সুখড়াই টোড়ী ইত্যাদি।
. মারবা ঠাট মারবা, পুরিয়া, সোহিনী, বরাবী, জয়েৎ, জয়েৎ কল্যাণ, ভংখার, ভাটিয়ার, বিভাস, সাজগিরি, মালীগোরা, পঞ্চম, পুরিয়া কল্যাণ, দীপক, বসন্ত, পূর্ব কল্যাণ ইত্যাদি।
. ভৈরব বা ভায়রো ঠাট ভৈরব বা ভায়রো, কালিংড়া, মেঘরানী, সৌরাষ্ট্র, যোগিয়া, রামকেলী, প্রভাবতী, গৌরী, ললিত পঞ্চম, সাবেরী, বংগাল ভৈরব, শিবমত ভৈরব, আনন্দ ভৈরব, গুণকরী, হিজাজ, আহীর ভৈরব, জিল্ফ, দেশ গৌড়, কৌশী ভৈরব, দেবরঞ্জনী, বসন্তমুখারী, বৈরাগী ভৈরব, মেঘ রঞ্জনী, মঙ্গল, মঙ্গল ভৈরব, প্রভাত, বঙ্গালী, ভৈরব-বাহার ইত্যাদি।
. ভৈরবী ঠাট ভৈরবী, মালকৌষ, ভূপাল টোড়ী, জংগলা, কোমল বাগেশ্ৰী, বসন্তমুখারী, বিলাসখানি টোড়ী, কৌশী-ভৈরবী, গুর্জরী, ছায়া টোড়ী, নাচাড়ি টোড়ী, ভৌপাল, যোগ-আসাবরি, লক্ষ্মী টোড়ী ইত্যাদি।
. পূরবী বা পুর্বী ঠাট পূরবী, গৌরী, রেবা, ত্রিবেণী, মালব, টংকি, শ্রী, জেতশ্রী, বসন্ত, পরজ, পুরিয়া ধানেশ্রী, হংস নারায়ণী, চিত্রা গৌরী, জয়শ্রী, টংকশ্রী, ধানেশ্রী, ললিত, ললিতা গৌরী, শিবরঞ্জনী, সাজগিরি, মনোহর ইত্যাদি।
১০. টোড়ী ঠাট টোড়ী বা তোড়ী, গুর্জরী টোড়ী, মূলতানী, বাহাদূরী টোড়ী, আহীরী-টোড়ী, দরবারী টোড়ী, ফিরোজখানী টোড়ী, মুদ্ৰাকী টোড়ী, মধুবন্তী ইত্যাদি।

 

 

 

 দশটি ঠাঁট থেকে উৎপন্ন রাগসমূহ

 

ঠাট ও রাগের তুলনা:

ক্র. নং ঠাট রাগ
১২টি স্বর হতে ঠাটের উৎপত্তি। ঠাট হতে রাগ উৎপত্তি।
ঠাট রচনার ৭টি স্বর অপরিহার্য। রাগ রচনায় ৫ থেকে ৭টি স্বর ব্যবহার হয়।
ঠাটে ৭টি স্বর ক্রমানুসারে থাকবে। রাগের স্বরগুলো ক্রমানুসারে নাও হতে পারে।
ঠাটে কেবলমাত্র আরোহী (উপর ওঠার ধারা) আছে। রাগে আরোহী ও অবরোহী (উপর-নিচ) দুইই থাকে।
ঠাটে কোন স্বর বর্জিত হয় না। রাগে ষড়জ ব্যতীত এক বা একাধিক স্বর বর্জিত হতে পারে।
ঠাটের রঞ্জকতা গুণ নেই। রাগের রঞ্জকতা গুণ আছে।
রাগের নামানুসারে ঠাটের নামকরণ হয়েছে। রাগ নিজের নামেই পরিচিত।
ঠাটের জাতি বিভাগ নেই। রাগের জাতি বিভাগ আছে।
ঠাটের সংখ্যা ১০টি। রাগের সংখ্যা অসংখ্য।
১০ ঠাট গাওয়া যায় না। রাগ গাওয়া হয়।
১১ ঠাটে বাদী ও সমবাদী স্বর নেই। রাগে বাদী ও সমবাদী স্বরের প্রয়োজন অপরিহার্য।
১২ ঠাটের নির্দিষ্ট সময় নেই। রাগের নির্দিষ্ট সময় আছে।
১৩ ঠাটে রসের অভিব্যক্তি নেই। রাগে রসের অভিব্যক্তি আছে।

Leave a Comment